পার্থসারথি পাণ্ডা
পুরাণ আলোকে বাহন ও দেবী
মৎস্য পুরানের একটি কাহিনিতে রয়েছে উমার গৌরী হয়ে ওঠার কথা। সেখানে বলা হয়েছে, সতী দেহত্যাগ করে হিমালয়ের মেয়ে হয়ে তো জন্মালেন, কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ হল ঘোর কালো। নাম হল, উমা। উমা অনেক তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করে তাঁকে স্বামী হিসেবে পেলেন। নিজে কালো বলে শিবের প্রতি খুব সন্দেহ, যদি কোন সুন্দরীর প্রেমে পড়েন। শ্মশানেমশানে ঘুরে বেড়ানো লোক তিনি, তাঁর কি গুণের ঘাট আছে! মহাদেবের ধারে কাছে যাতে কোন সুন্দরী ঘেঁষতে না পারে, তার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন মানসপুত্র বীরককে। সে ব্যাটা হাতে সোনার লাঠি নিয়ে কড়া পাহারা দিচ্ছে মহাদেবলোকের চারপাশে। তার চোখ এড়িয়ে একটা মাছি গলার সাধ্য নেই, তায় আবার সুন্দরী!
একদিন মহাদেব আর উমা বসে কথা বলছিলেন। হঠাৎ কথায় কথায় উমাকে বলে বসলেন, কালো। একটু দুষ্টুমি করেই বললেন, উমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল! যার যেখানে ব্যথা, সেখানে খোঁচা দিলে কারই বা মাথার ঠিক থাকে! স্বভাবতই উমা গেলেন দারুণ রেগে। তিনি আসন থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠে দাঁড়ালেন! শুনিয়ে দিলেন বেশ করে দু’চার কথা স্বামীকে। মহাদেব মহাকালরূপে তো ঘুটঘুটে কালো, তাহলে তাঁকে এভাবে খোঁচা দেওয়া কেন! তিনি চললেন তপস্যায়, যতক্ষণ না গায়ের রঙ ফর্সা হচ্ছে, ফিরবেন না! গায়ের রঙ নিয়ে কথা যখন উঠেছে, তখন এসপার-ওসপার কিছু একটা করেই আসবেন। তবে, যাবার আগে তাঁর বাধ্য বীরককে মহাদেবকে চোখে চোখে রাখতে বলে গেলেন।
পথে মায়ের সঙ্গে দেখা হল, বাবার সঙ্গে দেখা হল, তাঁদের বললেন জামাইয়ের খোঁটা দেওয়ার সমস্ত বৃত্তান্ত। শুনে তাঁরাও ছিঃছিঃ করলেন। তাঁদের সামনে উমা তাঁর মনের ক্ষসাপ গলায় নিয়ে শিবের জিভও যেন বিষ হয়েছে, নগ্ন শ্মশানচারী লোকটার লজ্জা তো গেছেই, ভুতদের সঙ্গে কারবার করে কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেই সহবৎও গেছে একেবারে! বাবা-মা উমাকে তবু বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে চাইলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। উমা তখন রাগে জ্বলছেন। এক নির্জন স্থানে গিয়ে শুরু করলেন ঘোর তপস্যা। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপের মাঝে নিজের চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে, দারুণ শীতে জলের মধ্যে বসে সে এক মারাত্মক কৃচ্ছসাধনা চলতে লাগল।
এদিকে হয়েছে এক কাণ্ড, অন্ধক দৈত্যকে বধ করেছিলেন শিব নিজের হাতে। তার ছেলে আড়ি। সে সুযোগ খুঁজছিল শিবকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তার আগে যথারীতি ব্রহ্মার তপস্যা করে একখানা বর বাগিয়ে নিল সে। অমরত্ব তো মিলবে না, তাই সে কায়দা করে বর চেয়েছিল যে, একবার রূপ পরিবর্তন করলে কিচ্ছুটি হবে না, কিন্তু দ্বিতীয়বার করলেই যেন তার মৃত্যু হয়—তার আগে তাকে কেউ মারতে পারবে না। এবার এই বরে বলীয়ান হয়ে, উমার চলে যাওয়ার খবর নিয়ে সে যখন শিবলোকে এলো, দেখল বীরকের প্রহরা। তার চোখ এড়িয়ে ঢোকার ফিকিরে কালো সাপের রূপ ধরে সে শিবলোকে চুপি চুপি প্রবেশ করলো। তারপর শিবের কাছে গিয়ে শিবকে হত্যা করবে ভাবতেই তার মতিচ্ছন্ন হল। সে ভুলেই গেল দ্বিতীয়বার রূপ পরিবর্তন করলে তার সাড়ে সর্বনাশ! উমার রূপ ধরলে সে সহজেই শিবের কাছে পৌঁছতে পারবে, তাই সে বুঝল না সুঝল উমার রূপ ধরে ফেলল। কিন্তু মহাদেবের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি আর এতই সোজা, দেখলেন গালের ওপর পদ্ম চিহ্নের জায়গায় ঘন লোমের অবর্ত! আর তাছাড়া যে জেদি উমা তপস্যা করবেন বলে বেরিয়েছেন, তিনি দুম করে ফেরেন কি করে! বুঝলেন, মায়াবীর মায়া ছাড়া এ কিছুই নয়। ব্যস, বেশ জায়গা মতো ছাড়লেন এক দশাসই ঘুষি। আর সেই রাম ঘুষিতেই একটা মরণ ডাক ছেড়ে পট করে আড়ি মরে গেল।
এদিকে ঘটেছে আর এক কাণ্ড। পবনদেবের হঠাৎ চোখ গিয়েছিল উমারূপী আড়ির দিকে। তাকে কোন সুন্দরী মহিলা ভেবে এবং শিবের কাছে যেতে দেখে তিনি ছুটলেন উমাকে খবর দিতে। তাঁর কাছে খবরটি পেয়ে মহাদেব কোন সুন্দরীর সঙ্গে পরকীয়া করছেন ভেবে তিনি তো রাগে একেবারে অস্থির! সেই রাগের চোটে তাঁর নাক থেকে বেরিয়ে এলো এক অগ্নিময় সিংহ। রাগে তার মুখে ঢুকে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলেন উমা। কিন্তু তাতে বাদ সাধলেন এসে ব্রহ্মা। তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত্র করে উমাকে বর দিতে চাইলেন। উমা চাইলেন তাঁর আকাঙ্খিত ফর্সা হওয়ার বর। ব্রহ্মা বললেন, তথাস্তু। ব্যস, অমনি উমার শরীর থেকে কালো আবরণ খুলে পড়ল, দেহ গৌর কাঞ্চন বর্ণ, ব্রহ্মা তাঁকে ‘গৌরী’ বলে সম্বোধন করলেন। এখান থেকে উমার আর এক নাম হল, গৌরী। কালো আবরণ থেকে আর এক দেবীর সৃষ্টি হল, ব্রহ্মা তাঁর নাম দিলেন ‘একেশ্বরী’। ব্রহ্মা সিংহটিকে তাঁর বাহন করে দিলেন। পরে অবশ্য এই সিংহটিই আবার উমার বাহন হবে, যখন তিনি হয়ে উঠবেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
গৌর বর্ণা গৌরী হয়ে শিবের কাছে গেলেন এবং মৃত আড়ি রাক্ষসকে দেখে তাঁর মিথ্যে ক্রোধের জন্য, মহাদেবের প্রতি মিথ্যে সন্দেহের জন্য লজ্জিত হলেন। শিবও কালো বর্ণের জন্য উমাকে খোঁটা দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। ফলে, শেষটা বেশ আর পাঁচটা সহজ দাম্পত্য জীবনের মতো মিলনান্তক হয়ে উঠল।