পলাশ বর্মন
ম্যারাপ
কী লিখব?
কিছুই তো মনে আসছে না! কতক্ষণ হল, আমি সাধের ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে ঠায় বসে আছি। এপাশ-ওপাশ নড়ছি-চড়ছি; মাঝে মাঝে বোতল খুলে, নিছক নিরুপায় বলে, শুধু সাদা জলই খাচ্ছি। আমাদের এই জল খাওয়া নিয়েও ইদানিং বাঙালি নিজেই নিজের খিল্লি ওড়াচ্ছে দেখছি। এও কোনও হিন্দির প্রভাব কিনা বুঝতে পারছি না। সে যা হয়, হোক গে। আমার ‘জল পান করছি’ বলায় আপত্তি আছে। উফফ, আবার একটা বিপত্তি। এই যে ‘আছে’ বললাম, এই ‘আছে’-তে ইদানিং আমি নেই হওয়ার চেষ্টা করছি। আমার প্রেমিকা আমার এই যত্রতত্র ‘আছে’ বলা শুনলেই বৎসরান্তের জমানো চুমুগুলো থেকে জরিমানা হিসেবে কয়েকটা চুমু বাদ দিয়ে দেবে বলেছে। ফলে, আমি অভ্যেস করছি ‘আপত্তি আছে’-র বদলে ‘আপত্তি রয়েছে’ বলার। আচ্ছা, ‘বদলে’ শব্দটাও কি সন্দেহজনক ঠেকছে?
এই-জ্জা, আমি তখন ভাবলাম, ‘সাদা জল’ নিয়ে লিখব। সেকথা ভুলে কী-সব নিয়ে হ্যাজালাম। তবে, ‘সাদা জল’ শুনে জিভে জল আনবেন না। এই ‘সাদা জল’ মানে কিন্তু বাকার্ডি, ভডকা, হোয়াইট ওয়াইন আমাদের চেনা বাংলা-চুল্লু ভাব্বেন না। এই পুজোর বাজারে অবশ্য ওসবের কথা একটু ভাবলেও মনে বল আসে। তবে, এযাত্রা আমি সেকথা বলছি না। ইন ফ্যাক্ট, এইটুকুনি যা বললাম, জাস্ট এমনি বলে ফেলেছি। ভুলে যান। আমি আসলে ওই ‘সাদা জল’ কথাটা কলকাতার মেট্রোরেলের স্টেশানের পানীয় জলের জায়গায় লেখা দেখে শিখেছি। আগে বুঝতাম না; এখন বুঝি।
যাক গে, যা বলছিলাম। তা অনেকক্ষণ ধরে ল্যাপটপের কীবোর্ডে আঙুল ছুঁয়ে বসে আছি। এক লাইনও লেখা আসছে না। মাঝে মাঝে ভাবছি, এই ল্যাপটপে লেখা ছেড়ে দিতে হবে। খুব বদ অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। শেষ কবে যে কাগজে কলম দিয়ে কবিতা লিখেছি, মনেই পড়ে না! মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতা তো খুব অভিমানী, হয়ত এইসব যন্ত্রপাতি তার সহ্য হচ্ছে না। তারপর, ভাবি, কলমও তো যন্ত্রই; আর, কালি-কাগজ উপকরণ। পাশাপাশি, কাগজের উপরে কলমে ছুঁয়ে ছুঁয়ে লেখাও তো কষ্ট করেই শিখতে হয়েছে, যথাযথ কলম ধরে আঙুল-চালনাও তো টেকনিক। এসব ভেবে-টেবে মন একটু শান্ত হল। মনে মনে মেনে নিতে চাইছি, কম্পিউটারও আরেক রকমের পদ্ধতি। বুঝলাম; মনও বসল। কিন্তু, আসল মালটি তো হচ্ছে না! কিছুতেই এক লাইন লেখা বেরোচ্ছে না।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি। সামনে খোলা ল্যাপটপ রাখা টেবিলে। টেবিলে কলমও অনেকগুলো আছে। ওহো, আছে না; রয়েছে। বেশ সাজিয়ে রাখা। কয়েকটা বই। বাংলা, ইংরেজি অভিধান। একটা বানান অভিধান। ইতস্তত খুলে রাখা ঘড়ি, ওয়ালেট, চশমা। কয়েক স্ট্রিপ ওষুধ। ডানদিকের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। টেবিলের এক কোণে সদ্য কেনা বিদ্যাসাগর রচনাবলী। সেই ছোটোবেলার ‘বর্ণ পরিচয়’ আর বিচ্ছিন্নভাবে পড়া কয়েকটা লেখার ছাড়া বিদ্যাসাগরকে তো তত মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়নি! এই শেষ কথাটা মনে হতেই বেশ খারাপ লাগল। নিজের উপর কেমন একটা বিরক্ত হলাম যেন। নিজেকে ধিক্কার জানালাম মনে মনে। এতদিন বিদ্যাসাগরকে পড়িনি! এর পরেও ভাবছি, এইভাবে ম্যারাপ সাজিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে, বসে থাকলেই হুড়হুড় করে লেখা নামবে! কী আহাম্মকি, মাইরি! কে দেয় আমাকে?
ম্যারাপ শব্দটা ভারি অদ্ভুত। ম্যারাপ মনে পড়তেই দুদ্দাড় করে গোটা ছোটোবেলা ফিরে এলো। ইন্টারনেট, গুগল, ল্যাপটপ, সাদা জল, গাঢ় রাত্রি, প্রয়োজনীয় মন-খারাপ-জারিত নির্জনতা ইত্যাদি মোটামুটি সমস্ত উপকরণ নিয়ে, বেশ যত্নে গুছিয়ে ম্যারাপ বেঁধে এই-যে আমি ঠায় বসে আছি, কীসের আশায়? একটা লাইন আসবে, আমি লিখব, লিখে আনন্দ পাবো, আনন্দে আরও লিখব, এই তো? হল কই? এভাবে কি হয় কিছু? এই-যে গোটা কলকাতায় এখন এত মানুষের ঢল চলেছে রাস্তায়, কী উদ্ভ্রান্তের মতো সমস্ত কিছু দেখে নেবে বলে ছুটে চলেছে, তাতে কি দেখা হচ্ছে? কী দেখা হচ্ছে? একেকটা প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে আরেক প্যান্ডেল, তারপরের প্যান্ডেল দেখে ভোরবেলা বাড়ি ফিরে মনে করে দেখবেন তো, ঠিক কী কী দেখা হল? দেখবেন, অল্প মনে পড়ছে, দু-একটা বিশেষ খণ্ড মনে আসছে। একটার সঙ্গে আরেকটা মিশে যাচ্ছে। এক জায়গার গল্পে আরও অন্য অন্য গল্প মিশে একাকার হয়ে, কী যে ঘটছে, বোঝা মুশকিল।
এখনো আমার লেখাটা এলো না। আজ আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রায় ভোর হয়ে এলো। আমি এখনও অপেক্ষা করছি। যেন আধো ঘুমে আধো জাগরণে কোনও স্বপ্ন আসবে বলে অপেক্ষা করছি। একটু পরেই অনতিদূরের কোনও বাড়ি থেকে বেজে উঠবে ছোটোবেলার রেডিও, বীরেন ভদ্রের মহালয়া। মনে পড়বে, স্কুল থেকে ফেরার পথে একবার করে দেখে নেব, ঠাকুরের গায়ে ক-মাটি শুকোলো। মনে পড়বে, পাড়ার ফি বছরের পুজো মণ্ডপের কাছে বাঁশ পড়ে গেছে। কদিন বাদেই গ্রামের এর-তার বাড়ি থেকে কাচা থানকাপড়-ধুতি-বেডশিট চেয়ে নিয়ে এসে, মোটামুটি রঙ মিলিয়ে শুরু হবে ম্যারাপ বাঁধা। যেন ঘুম চোখ আস্তে আস্তে খুলব, আর ক্রমে উঠোনে ফুটবে কুয়াশা ভাঙার আলো। যেন উঠোনের পাশের শিউলি তলায় ঝরে থাকবে অনেক গোপন জমানো ব্যথা।
ল্যাপটপের চার্জ ফুরিয়ে এলো। বাইরে একটা-দুটো পাখি ডাকছে। বুঝলাম, আজ আর সত্যিই কিছু লিখতে পারলাম না।