সংকল্প সেনগুপ্ত:
বাংলা ভাষা জীবনানন্দে (দাশ) যা সতীনাথে (ভাদুড়ী) তা না, হুতুমে যেমন তার থেকে বহু গুণে আলাদা ত্রৈলোক্যনাথের (মুখোপাধ্যায়) বাক্য সমন্বয়। এইরকম করে শক্তি (চট্টোপাধ্যায়) থেকে কমলকুমার (মজুমদার) আলাদা, শিবরাম (চক্কোত্তি) থেকে হিমানীশ (গোস্বামী), তারাপদ (রায়) থেকে শীর্ষেন্দু-সুনীল-উৎপল-জয়-মৃদুল-সুবোধ, কিংবা স্বদেশ থেকে নবারুণ (ভট্টাচার্য) ঘুরে কমল (চক্রবর্তী) হয়ে হাল আমলে শূন্য, ও শূন্য পরবর্তী কতরকম কাব্য ও গদ্যভাষার যে সাক্ষী থাকছে বাঙালি পাঠক! কারণ সহজ—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর পাঁচটা কাণ্ডের মতোই বঙ্গভাষাও অসীম সম্ভাবনার ড্রয়ার! বিষয়টা নিশ্চয়ই ‘লজ্জাসকর’ নয়, ‘কেন কী’…। থাক, আপাতত তোলা থাক।
শুধু বলা যাক, উক্ত সূত্রেই চ্যানেল হিন্দুস্তানের নতুন ধারাবাহিক সংকল্প সেনগুপ্তের ‘ভাষার ভাসান’! পড়ুন, রাগুন, হাসুন, কাঁদুন কিংবা নিছক প্রশংসা করুন হেব্বি। কিন্তু চাপ নেবেন না। ইয়ো বাংলা, জয় বাংলা!
ভটভটিতে ভটচাজের বউ, আর্যর বাংলায় আগমন
মূল লেখায় যাওয়ার আগে বলি, আমার কাঁপা হাতের লেখা যে ছাপার অক্ষরে (হোক-না অন্তর্জাল) প্রকাশ পেতে পারে, আমার সম্পাদক-বন্ধুর পাল্লায় না পড়লে জানতে পারতাম না৷ তাই শুরুতেই ‘আমা-কৃত অজ্ঞতা’বশত তিনি যে সম্মান দেখিয়েছেন, সে-কারণে তাঁকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই৷
যাই হোক, সেদিন আমাদের পাড়ার ‘চাড্ডা’ (চা + আড্ডা)-য় বসে আছি৷ হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন পাড়ায় নতুন-আসা ভটচাজবাবু৷ ঢুকেই বললেন, চটজলদি এক কাপ চা দাও ভাই৷ গলাটা ভিজিয়েই আবার ছেলের স্কুলে দৌড়োতে হবে গিন্নির সঙ্গে৷
আমি বললুম, কেন দাদা, কোনও সমস্যা?
ভটচাজবাবু বললেন, সমস্যা বলে সমস্যা! ছেলের গার্জেন কল হয়েছে৷
—সে কী মশাই! আপনার ছেলে তো শুনেছি পড়াশোনায় খারাপ নয়?
—আরে মশাই, ওর আর কী দোষ! ছোট থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে৷ হঠাৎ করে এ-গ্রেড বেঙ্গলি মিডিয়ামে বাংলা লিখতে দিলে ও-ই বা কী করে?
—ও, আপনার ছেলে বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়ে? বাংলা মাধ্যমে নয়?
নবারুণ বলল, এই, তুই ফোড়ন-কাটা বন্ধ করবি? দেখছিস ভদ্রলোকের নাজেহাল অবস্থা৷ ভটচাজবাবু, আপনার কি একটু খুলে বলার সময় হবে?
ভটচাজবাবু বললেন, উনি তো ঠিকই বলেছেন৷ আমি কিনা ভেতো পাঠশালায় পড়ে এখন যদি বাংলা মাধ্যমকে বেঙ্গলি মিডিয়াম বলি, তাহলে আমার ছেলেও তো তেমনই জগাখিচুড়ি বাংলা লিখবে৷
আমি বললুম, আপনাকে আমার হয়ে সাফাই গাইতে হবে না, আপনি আপনার কথাটা আগে শেষ করুন৷
—হ্যাঁ, গিন্নি এসে পড়বেন স্কুটিতে৷ তার আগে এই শুনুন, ছেলে কী লিখেছে!
এই বলে, একটা খাতা বার করে ভটচাজবাবু বললেন, স্কুলে বাংলার স্যার প্রত্যেক ছাত্রকে নিজের সম্বন্ধে কিছু লিখতে দিয়েছিলেন৷ তা আমার ছেলে আর্য লিখেছে—
আমার নাম আরিয়া ভট্টাচারিয়া৷ আমার Age 10 years৷ আমি Class V-এ পড়ি৷ আমি আমার Dad, Mom আর আমার Li’l sis-এর সাথে North Calcutta-র কাঁকুড়গাছিতে একটা 3 BHK Flat-এ থাকি৷ আগে আমরা New Town-এ একটা 3BHK Flat-এ থাকতাম৷ সেই জায়গাটা খুব Beautiful ছিল৷ আমি সেখানে একটা Renowned English Medium School-এ পড়তাম৷ Dad-এর Job transfer হওয়ায় এই নতুন জায়গাটায় আসতে হয়েছে৷ এই জায়গাটা বড্ড Dense৷ আমি এখানে একটা Renowned Bengali Medium School-এ ভরতি হয়েছি৷ আমার ওখানে অনেক Friends ছিল, এখানে এখনও কোনও Friend হয়নি৷ তবে খুব Soon হবে, I’m sure. আমি আমার Sis-কে খুব Pamper করি, ও-ও আমাকে খুব Like করে৷ I can’t write any more. কেন-কী, Bengali-তে লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে৷
এই বলে কিছুক্ষণ থামলেন ভটচাজবাবু৷ তারপর বললেন, বলুন তো আমার অবস্থা! গিন্নি তো রেগে কাঁই৷ বলছেন, এইজন্যেই পইপই করে বলেছিলাম, English Medium-এ দাও৷ তা না, বাবু ভালো Bengali Medium-এ ছেলেকে পড়াবেন৷ Mother tounge-এ Educate করবেন৷ নাও ঠ্যালা! আমি কিন্তু স্কুলে স্যারের সামনে স্পিকটি নট৷ You will have to face everything.
ভটচাজবাবু কথা শেষ করতে-না করতে স্কুটিতে তাঁর উত্তমার্ধ (Best half), সর্বাধুনিকা স্ত্রী হাজির৷ কথা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, কী গো, তোমার Tea meeting শেষ হল? আমি না আসলে তো তুমি আড্ডাই মেরে যেতে৷ এবার Back-এ বসে আমাকে Rescue করো!
অগত্যা ভটচাজবাবু বিদায় নিলেন গিন্নির শকটসঙ্গী হয়ে৷
আমি আড্ডায় উপস্থিত আর সকলের দিকে তাকিয়ে বললুম, Godown যেমন হবে, Goods-ও তো তেমনই হবে, না কী? তবে যা-ই বলিস, ছোট ভটচাজের বাক্যগঠনক্ষমতা কিন্তু ঈর্ষণীয়৷ কী বলিস তোরা?
উত্তরে সবাই একচোট হেসে নিল৷