সঞ্জয় সিংহ :
( জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় )
কান্নায় ভেঙে পড়লেন মমতা : –
রাজনৈতিক বিপর্যয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বহুবার এসেছে। আর ষড়যন্ত্র! রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছতে প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে অনেক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে বিপর্যয় বা ষড়যন্ত্রের ধাক্কায় সচরাচর তিনি ভেঙে পড়েন না।
কিন্তু আচমকা আঘাতে বেশ কয়েকবার কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এর মধ্যে একটি ঘটনা অনেকেই মানেন। বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও সংবাদপত্রের পাতায় অনেকেই সেই ঘটনা দেখেছেন, পড়েছেন।
দিনটা ছিল ২০০৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। আগের রাতেই মমতাদি ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জানালেন, মমতাদি সিঙ্গুরে যাচ্ছেন। কেন? তাঁদের কাছে খবর এসেছে, সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি দেওয়ার নামে নকল কৃষক বা জমি মালিকদের তা দেওয়া হচ্ছে এবং এই ‘কুকাজ’ স্থানীয় সিপিএম নেতাদের মাধ্যমেই হচ্ছে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে মমতাদি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চেক বিলি বন্ধের দাবি নিয়ে অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করে দিলেন। হুগলি জেলা প্রশাসনও বসে রইল না। চারিদিকে ঘিরে ফেলল সশস্ত্র পুলিশ। গভীর রাতে শুরু হল ‘অপারেশন’। বি ডি ও দফতরের সামনে থেকে মমতাদি-সহ মহিলাদের মারতে মারতে, কাপড়জামা ছিঁড়ে দিয়ে পুলিশ গাড়িতে তুলে কলকাতায় পাঠিয়ে দিল।
রাতের শেষ প্রহরেই পুলিশ প্রশাসনের ‘অমানবিক আচরণের’ প্রতিবাদে ময়দানে গান্ধি মূর্তির পাদদেশে মমতাদি অবস্থানে বসলেন।
ভোর হতে-না-হতেই সেই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বেলা যত বাড়ছে ময়দানে ভিড়ও তত বাড়ছে। তৃণমূল নেতৃত্ব তো রাত থেকেই সেখানে হাজির ছিলেন। এ বার এলেন কংগ্রেস নেতারা। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি তখন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে তিনি এলেন। মমতাদির পাশে এসে বসলেন প্রিয়দা। জানতে চাইলেন, “মমতা কি হয়েছে তোর!” প্রথমে ক্রোধে প্রায় ফেটে পড়লেন তৃণমূল নেত্রী। সবিস্তারে প্রিয়বাবুকে জানালেন, কীভাবে পুলিশ তাঁর সঙ্গে অভব্য আচরণ করেছে, মেরেছে! তাঁর জামা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে! কী অশ্লীল ভাষায় তাঁকে গালিগালাজ করেছে! বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন ‘বাংলার বাঘিনী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, “প্রিয়দা এই বাংলায় বোধহয় আর রাজনীতি করা যাবে না।” প্রিয়বাবু তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। মমতাদি কাঁদছেন! এর আগে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তো ওঁর চোখে জল দেখিনি! পরে বুঝেছিলাম, বাংলার রাজনীতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা নেত্রী ভাবতেও পারেননি, বাঙালি পুলিশ একজন মহিলাকে এত ঘৃণ্যভাবে হেনস্থা করতে পারে। আঘাতটা তাঁর হৃদয়ে লেগেছিল বলেই লজ্জা, অপমানে চোখে জল এসেছিল বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’র।
আরও একবারের ঘটনা। বড় মর্মান্তিক ও দুঃখের ঘটনা। আমাদের অনেকেরই খুবই কাছের মানুষ ছিলেন গৌতম বসু। মমতাদির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। চোস্ত ইংরেজি বলতেন এবং লিখতেন গৌতম। আমাদের কাছে বুলান নামেই পরিচিত। সেই বুলান তাঁর কয়েকজন পরিচিতকে নিয়ে ওডিশা থেকে গাড়িতে কলকাতায় ফিরছিলেন। প্রচণ্ড বৃষ্টি তো ছিলই ওডিশায় তখন বন্যা শুরু হয়েছে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওঁরা পথে আটকে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গীদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি ভেসে গিয়েছিলেন বুলান। তারপর যে-দিন তাঁর দেহ উদ্ধার করে কলকাতায় নিয়ে আসা হল সেদিন বিকেলেই কালীঘাটে ছিল মমতাদির সাংবাদিক সন্মেলন।
কিন্তু সম্মেলন করতে পারলেন না মমতাদি। দু’চোখ লাল। চোখের পাতা ভেজা। ধরা গলায় বললেন, “আজ আমার বড় দুঃখের…।” কথা শেষ করতে পারলেন না। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন নেত্রী। তবে এই কান্না বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন গৌতমের বাড়ির দিকে। তারপর যথার্থ নেত্রীর মতোই গৌতমের শেষকৃত্য তদারকি করলেন।
শোকে প্রিয়জন হারানোর বেদনায় মন চুরমার হয়ে গেলেও, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রী বলে কথা। তাই পরিচিত চেহারায় তাঁকে দেখা গেল। তাঁর কাছে কর্তব্য পালনই তখন একমাত্র লক্ষ্য।
তবে তিনি খেপে গেলে কী হতে পারে একবার টের পেয়েছিলাম হাড়ে হাড়ে। পরের পর্বে সে কাহিনি।
অনবদ্য লেখনীতে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনার এই প্রয়াসকে অন্তর থেকে স্বাগত জানাই ।
প্রসেনজিৎ ঘোষ
Darun,,, Sanjay Da. Just Chaliye Jaan.
Darun Hoyeche.