বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় :
প্রায় তেত্রিশ বছর। বড় কম সময় নয় । এই সময়ের ব্যবধানে যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে মনে হয়, ‘কেউ কথা রাখেনি’। আবার আমার মতো প্রৌঢ়ের কাছে সেই সময়ের স্মৃতি প্রায়শই দ্বিচারিতা করে। বিভ্রম ঘটায়। কিন্তু তেত্রিশ বছর আগে এক হিমেল সন্ধ্যার স্মৃতি আজও অমলীন।
১৯৮৪ সাল নভেম্বর মাস।এক সাপ্তাহিকে আধা সাপ্তাহিক হিসেবে লেখালেখি করছি,সেই সময়ের ঘটনা।
সারা দেশজুড়ে লোকসভার ভোটযুদ্ধ চলছে।মাসখানেক আগেই খুন হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী।ওই ভোটে তখন কংগ্রেসের কান্ডারি রাজীব গান্ধী। সেই ভোটের পরিমণ্ডলে বিভিন্ন মানুষ, বিশেষ করে অগ্রজ প্রবীণ সাংবাদিকদের কাছে ভোট নিয়ে নানা বিশ্লেষণ ,আলাপ-আলোচনা শুনি, তেমন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ভোট সংক্রান্ত নানা টুকরো কথা কানে আসে।
যাদবপুর তখন সিপিএমের কাছে ‘লালদুর্গ’ নামে পরিচিত। সেখানে সিপিএমের জাঁদরেল প্রার্থী ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্যোপাধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী কালীঘাটের একটি মেয়ে, নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ মানুষেরা অনেকেই তাঁকে চেনে না। তবে হাজরা, আশুতোষ কলেজ চত্বরে, বালিগঞ্জ, কসবা তাঁকে চেনেন। কিন্তু সোমনাথবাবুর মতো জবরদস্ত সিপিএম প্রার্থীর কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তখন অনেকেই ‘লিলিপুট’ বলছেন। কিন্তু ভোটের দিন যত এগোচ্ছে ,ব্যাপারটা অন্যরকম হচ্ছে। যেমন কেউ বলছেন যাদবপুরের অলিতেগলিতে চটি ফটফটিয়ে মমতা চরকির মতো ঘুরছেন। বাড়িতে ঢুকে পড়ছেন। গৃহকর্ত্রী তখন উনুনে কড়া চাপিয়ে বেগুন ভাজছেন। কংগ্রেস প্রার্থী সটান তাঁর কাছে ঢুকে বলছেন,”বউদি কি রাঁধছেন? ও বেগুন ভাজছেন! আমি কয়েকটা ভেজে দেব?” আবার কোনও বাড়িতে কংগ্রেস প্রার্থী দেখছেন বাড়ির মেয়ে সেলাই করছেন, তাঁর পাশে বসে গিয়ে বলছেন,”আমিও খুব ভাল সেলাই জানি। তুমি কি সেলাই করছো?” কংগ্রেসপ্রার্থীকে ঘিরে তাই মানুষের কৌতুহল ক্রমশ বাড়ছে। কাগজে তখন পড়েছি, খোদ বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনও মমতার ভয়ে যাদবপুরে প্রচারে নেমেছেন।
এখানেই শেষ নয়। যাদবপুর তখন কলোনি অধ্যুষিত এলাকা। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই উদ্বাস্তু। তাঁদের তখন একটাই দাবি- ‘নিঃশর্ত জমির দলিল চাই।’ কংগ্রেসপ্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সেই দাবি এক হাতিয়ার। আমাদের কাছে তখন খবর, যাদবপুরে ঝড় আসছে। ‘মমতা – ঝড়’।
সত্যিই হলও তাই। ঝড়ে হেলে পড়লো ‘লালদুর্গ’। ছোট্টখাট্টো চেহারার একরত্তি মেয়ে তখন নোয়ান অফ যাদবপুর। প্রায় কুড়ি হাজার ভোটে জিতলেন মমতা। ছবিতে দেখলেও তাঁকে তখন সামনে থেকে দেখিনি। ভোটের ফল ঘোষণার কয়েকদিন বাদে বাড়ি ফিরব বলে ধর্মতলার বাসগুমটির কাছে গেছি। সেই হিমেল সন্ধ্যায় শহিদ মিনার ময়দানে কংগ্রেসের বিজয় সমাবেশ হচ্ছে। সেবার বাংলা থেকে মমতা-সহ ষোলোজন কংগ্রেস সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
সেই সভায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি সাংসদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করাচ্ছেন। ভিড় ঠেলে আমি প্রায় মন্ত্রীর কাছাকাছি চলে গেলাম। প্রিয়দা মাইকে বলছেন, ”এই হল আমাদের বোন মমতা, ও যাদবপুরের জায়েন্ট কিলার।” এখনকার মতো সেদিনও সাদা শাড়ি পড়ে সলজ্জ হেসে জনতাকে নমস্কার করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দূর থেকে দেখে মনে হল, তাঁর চোখের কোণটা যেন চিকচিক করছে। পরে অবশ্য মমতাদি-কে দু’ একবার কাঁদতে দেখেছি, সেকথা আজ থাক।
Well done Sanjay Da, nice writting on your opening performance. Eagerly waiting to know more from you about Didimoni. Keep it up.