Breaking News
Home / TRENDING / মহম্মদ রফি সঙ্গীতজগতের তানসেন

মহম্মদ রফি সঙ্গীতজগতের তানসেন

কমলেন্দু সরকার  :

২৪ জুলাই ১৯৮০ মহানায়কের মৃত্যু। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের একটা অধ্যায় শেষ হল। ঠিক এক সপ্তাহ পর ৩১ জুলাই প্রয়াত হলেন সঙ্গীতজগতের তানসেন মহম্মদ রফি। উত্তমকুমার এবং রফি দু’জনেই মধ্য পঞ্চাশে চলে গিয়েছিলেন নিজেদের দুনিয়া ছেড়ে। দু’জনেই কাজ করতে করতেই দর্শক আর শ্রোতাদের কাছ থেকে বিনা নোটিশেই চলে গেলেন। উত্তমকুমার ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শুটিং শেষ না করেই চিরদিনের মতো ছেড়ে ছিলেন স্টুডিয়ো। আর মহম্মদ রফি ‘আস পাস’ ছবির রেকর্ডিং করে বাড়ি ফিরেছিলেন। বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল সব। সেই গানের সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল তো বিশ্বাসই করতে পারেননি।
রফির দাদার ছিল লাহোর শহরে একটি সেলুন। রফি তিনি নিয়ে যেতেন কাজ শেখাবার জন্য। কিন্তু রফি মজে থাকতেন গানে। সেলুনে বসেও চালাতেন সঙ্গীতচর্চা। দাদা মহম্মদ দীন ভাইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাননি। বন্ধু তাজ মুলককে ভার দিলেন ভাইকে গান শেখাবার। তারপর অনেকের কাছেই তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা। তার মধ্যে ছিলেন কিরানা ঘরানার আবদুল ওহায়িদ খান, বড়ে গুলাম আলি খান প্রমুখ।
তখনও নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ আসেনি রফির। সেই সুযোগ এল। সেইসময় রফির বয়স মাত্র ১৩। বছরটা ১৯৩৭। লাহোরে কুন্দনলাল সায়গল আর জোহরা বাঈয়ের সঙ্গে গাইতে হবে তাঁকে। বিন্দুমাত্র তিনি ঘাবড়ে যাননি। রফি খালি গলায় গান গেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন শ্রোতাদের তো বটেই সায়গলও অবাক হয়েছিলেন।
রেডিয়োতে গান গাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্লেব্যাক করলেন। শ্যাম সুন্দর এই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পাঞ্জাবি এই ছবির নাম ছিল ‘গুল বালুচ’। রফির প্রথম রেকর্ডিং ছিল ১৯৪১-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি। জিনত বেগমের সঙ্গে গানটি ছিল—- সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি।
বলিউডের প্রযোজক-অভিনেতা নাসির খান রফির গান শুনে বোম্বাই আসতে অনুরোধ করেছিলেন। দাদা দীন মহম্মদ ভাইকে বোম্বাই পাঠিয়েছিলেন। বলিউডে এসে রফির নতুন জীবন শুরু হল। এই সময় তাঁর প্রতিযোগী ছিলেন সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, জি এম দুরানির মতো তারকা। তারপর এলেন তালাত মামুদ, মুকেশ, মান্না দে, হেমন্ত, কিশোরকুমার প্রমুখ। কিন্তু মহম্মদ রফি সবাইকে টপকে তরতর করে এগোতে লাগলেন।
অথচ বোম্বে এসে খুব কষ্টেই দিন কেটেছে তাঁর। মহম্মদ আলি রোডের একটি চারতলায় থাকতেন কোনওরকমে। প্লেব্যাক বা গান গাওয়ার জন্য হেঁটে হেঁটে ঘুরতেন স্টুডিয়োয় স্টুডিয়োয়। অনেক সময় টাকাপয়সা থাকত না। তখন রেকর্ডিং স্টুডিয়োর কাছাকাছি কোনও রেলস্টেশনে রাতটা কাটিয়ে দিতেন! খরচ বাঁচাতেন এমন করে! সুযোগ এল একদিন। ছবির নাম ‘গাঁও কি গোরি’। সুযোগ দিলেন সেই শ্যাম সুন্দরই। প্রথম প্লেব্যাক করলেন হিন্দি ছবিতে। গানটি ছিল ‘আজি দিল হ্যায় কাবু মে দিলদার’।
১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট দেশভাগ হল। রফি এদেশেই থেকে গেছিলেন। স্বাধীনতার দিন তাঁর ডাক পড়েছিল লালকেল্লায়। রফি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সামনে গাইলেন ‘লেহরাও ত্রিরঙ্গা লেহরাও’। গান শুনে মুগ্ধ জওহরলাল বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তখন কানে বাজছে তাঁর উপস্থিত জনতার করতালি। রফির মনে হয়েছিল স্বপ্ন দেখছেন! যখন সম্বিত ফিরল তখন বুঝলেন না, স্বপ্ন নয়! সত্যি তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন লালকেল্লায়। সামনে হাজারো হাজারো জনতা।
শুরু হয়েছিল সোনার সঙ্গীতযাত্রা। সব সঙ্গীত পরিচালকের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। শুধু সুরকারদের কেন, নায়কদেরও। প্রচুর লড়াই করে সফল হয়েছিলেন। আসলে বলিউডে আসবার আগে বাবার কথাগুলো মনে ছিল তাঁর। কী ছিল সে কথা! ট্রেনে ওঠার আগে বাবা বলেছিলেন, যদি তুমি কাজে সফল না হও তাহলে আর ফিরো না লাহোরে। আমি ভুলে যাব রফি নামে আমার কোনও পুত্রসন্তান ছিল।
বেহন্দিবাজারে কিনলেন ছোট্ট একটা বাড়ি। ছোট্ট একটা গাড়িও ঢুকলো গ্যারেজে। আবার কামাল করলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়ার পর গেয়েছিলেন ‘শুনো আয় দুনিয়াওয়ালো’। গানটি লিখেছিলেন রাজেন্দ্রকৃষণ। সুর করেছিলেন হুসনলাল ভগতরাম। হিন্দি ছবির এই বিখ্যাত সুরকার রফিকে বহু সুযোগ দিয়েছিলেন। রফিও তাঁর মর্যাদা রেখেছিলেন।
রফি নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠলেও কোনওদিন কোনও সুরকারের কাজে নাক গলাতেন না। তাঁর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল নৌশাদের। শঙ্কর-জয়কিষাণের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল পরিবর্তন এসেছিল হিন্দি গানের জগতে। রফির সঙ্গীত প্রতিভারও উন্মোচন হয়েছিল। বিশেষ করে ‘জংলি’র ‘চায়ে কোই মুঝে জংলি কহে’। মাতিয়ে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। হিন্দি গানের ট্রেন্ডেই পরিবর্বতন এনেছিলেন রফি। পাশাপাশি সুরকারদ্বয়ও। তার আগেও অবশ্য রফিকে খুব সুন্দর ব্যবহার করেছিলেন ও পি নায়ার। মহম্মদ রফি প্রায় সমস্ত প্রথম সারির নায়কদের জন্য নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছিলেন। নায়কদের জন্য যেমন রফি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, তেমনই রফির জন্যও নায়কেরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন হিন্দি ছবিতে। রফির একটা মস্ত গুণ ছিল যে-নায়কের কণ্ঠে গাইতেন মনে হত যেন সেই নায়কই গানটি গাইছেন। এমনই ড্রামা ছিল রফির কণ্ঠে!
মহম্মদ রফির শেষ গান আনন্দ বক্সির লেখা, সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, গানে সঙ্গী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ছবি ‘আস পাস’। তারিখ ১৯৮০-র ২৬ জুলাই। রফিকে সুরকার রবীন্দ্র জৈন ডাকতেন তানসেন বলে। হিন্দি ছবির এই তানসেন চলে গেছেন ৩৮ বছর। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য, আবেগ, আনন্দ, প্রেম এখনও ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্য কোনও এক জগতে। যে জগতে অসীম আনন্দ।

মহম্মদ রফির প্রয়াণ দিবসে চ্যানেল হিন্দুস্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন

বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন :- 

চরম অবহেলিত অলিম্পিকে প্রথম ব্যক্তিগত পদকজয়ী কুস্তিগির দাদাসাহেব যাদবকে নিয়ে ছবি করছেন শ্যাম বেনেগল

Spread the love

Check Also

পুলিশ ডায়রির আগেই পোস্টমর্টেম! দাহ করার পর এফআইআর! বিস্মিত সুপ্রিম কোর্ট

মঙ্গলবার আরজি কর মামলার শুনানি ছিল সুপ্রিম কোর্টে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে মহিলা ডাক্তারকে ধর্ষণ-হত্যার তদন্তে …

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *