সীমিতা মুখোপাধ্যায় :
গল্প
আতরের ঘ্রাণ
——————-
সৌভাগ্যকে স্বপ্ন দেখে অতি আশ্চর্য হয়ে আতরের ঘুম ভাঙল। স্বপ্নটা এরকম― আতর আর সৌভাগ্য কোথায় যেন বেশ বসে আছে, আতর বলছে— “সৌভাগ্য, তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।” আর সৌভাগ্য খিলখিল করে হাসছে আর বলছে— “তুমি আগে কেন বলনি আমায়? আগে বলনি কেন?”
আজকাল সৌভাগ্য বলে ছেলেটির সঙ্গে আতরের একটু বেশি কথা হচ্ছে। সৌভাগ্য আর আতর দুজনেই লেখালেখি করে। একই বন্ধুবৃত্তের মধ্যে থেকেও দুজনের কখনো দেখা হয়নি। এখন এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে দেখা হওয়া সম্ভবও নয়। আতর সে-সব ভাবছেও না। আতরের কথা বলতে ভালো লাগছে। কথা না বলে বলে যে-আতর কথা বলতে ক্রমে ভুলতে বসেছিল, সে আজকাল কারো ফোনের জন্য অপেক্ষা করে। হোয়াটসঅ্যাপে সৌভাগ্যের নামটা পিছন দিকে চলে গেলে আতরের বুকের মধ্যে এক ভয়ানক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু, এ-সব কথা সৌভাগ্যকে বলা যাবে না।
সৌভাগ্য বারবার বলে— “আতর, তোমার সঙ্গে আমার আগে কেন দেখা হল না? তোমাকে আমি আগে কেন পেলাম না?” আতর রেগে যায়, বলে— “যেটা হয়নি, সেটা হয়নি। পিছনের দিকে তাকিয়ে কী লাভ? তুমি তোমার অতীতকে বদলাতে পারবে না। তার চেয়ে এভাবে ভাবো— কাল আমাদের অন্য একটা জন্ম ছিল। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা নতুন জন্ম পেয়েছি, রাতে যখন ঘুমাতে যাব আমাদের আজকের জন্মটা শেষ হয়ে যাবে।” আতরের জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় না— “সৌভাগ্য, আগে দেখা হলে কী করতে? সেই আগে-টা কবে?” তারপর আতরের খুব হাসি পায়, হায় রে ওদের তো দেখাই হয়নি এখনো! আতর জড়িয়ে পড়ছে। ভগ্ন শরীর, পাথরের মন আর ট্রাঙ্কুলাইজারের আচ্ছন্নতা থেকে আবার জেগে উঠছে আতরের বালিকা-সুলভ অনুভূতিগুলো।
আতর বা সৌভাগ্য কেউই ঠিক ধোয়া তুলসিপাতা নয়, লেখকরা যেমন হয়, ওরা তেমনি। মদ, গাঁজা এবং এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে চলে যাওয়া— ওদের নেশা। একে অপরকে এর চেয়ে ভালোভাবে আবিষ্কার করতেও ওরা চায়নি।
সৌভাগ্যের চল্লিশ আর আতরের আটত্রিশ। দেখে যদিও ওদের বয়স বোঝা যায় না, গেলেও অবশ্য ওদের কিছু যায়-আসত না। দুজনেই বিবাহিত এবং যে যার বিবাহিত জীবনে চূড়ান্ত ব্যর্থ। ‘অতৃপ্ত’ বললে হয়তো ভুল শব্দ ব্যবহার করা হয়ে যাবে। ওরা মনে করে, নিজেদের দোষেই ওরা যে যার সংসারগুলোকে এলোমেলো করে ফেলেছে। সৌভাগ্যের একটি কন্যা সন্তান আছে। আতর সে পথে গিয়ে আর মায়া বাড়াতে চায়নি।
কিছুক্ষণ বাদে আতরের সঙ্গে সৌভাগ্যর কথা হল। সৌভাগ্য জানাল, সেও নাকি আতরকে স্বপ্নে দেখেছে। আতরের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল, জিজ্ঞাসা করল— “কী স্বপ্ন?”
— “বলা যাবে না।”
আতরের আর কথা বাড়াতে সাহস হল না। তাছাড়া, এক বারের বেশি দু-বার কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা আতরের অভ্যাস নয়। সে নিজের স্বপ্নটাও চুপচাপ চেপে গেল।
দুদিন বাদে এক রাতে সৌভাগ্যর সঙ্গে আতরের কথা হচ্ছে। সৌভাগ্য গান গাইছে— “কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।/ চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি/ গোপনে তোমারে, সখি, কত ভালোবাসি।” আতর বলল— “সখি!” উত্তর এল— “গানটাকে গান হিসেবেই শোনো। যেমন, আমরা কবিতাকে কবিতা হিসেবেই পড়ি।” আতরের হঠাৎ আজ মনে বেশ একটা কৌতুকের উদ্রেক হল, বলল— “তুমি সেদিন আমাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেছিলে, বলবে না?”
— “না, ভুলভাল। তুমি আমায় ভুল বুঝবে।”
— “ভুল বুঝব না, বলো।”
— “তোমাকে বলাই যায়। আমি দেখলাম, পুরুলিয়ায় যাচ্ছি। ট্রেনের জানলা দিয়ে পলাশের বন দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি ট্রেনের মধ্যে তুমি। তোমাকে আমি আমার পাশে বসিয়েছি …”
— “তারপর?”
— “আমার বুকের মধ্যে তোমার মাথাটা চেপে ধরেছি। আমার খুব ভালো লাগছে।”
আতরের যে কী হল, শুনে সে তখন লজ্জায় লাল। ফোন ধরেই খিলখিল করে হাসতে থাকল। হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিল। কিছুক্ষণ পরে ফোন করে বলল— “সরি।” রাগের চোটে সৌভাগ্য ততক্ষণে একটা জয়েন্ট ধরিয়ে ফেলেছে। বলল— “এ-ভাবে হাসার কী আছে?”
— “সমস্ত ক্রিয়ারই তো সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এই অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে হেসেছি।”
— “মানে কী?”
— “তোমার স্বপ্নের কথা শুনে আমার যা হল, তা কোনো না কোনো ভাবে তো বের করতে হত। আমি হেসে বের করেছি। স্বাভাবিক মানুষ হলে হয়তো অন্য কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠত।”
সৌভাগ্য ঠোঁট কামড়ে ওপর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ মিটিমিটি হাসল। আতর ফোনে আছে বলে সে-দৃশ্য দেখতে পেল না। আতরের হোয়াটসঅ্যাপে সৌভাগ্য একটা ইউটিউব লিঙ্ক পাঠাল— “লাগ যা গলে কে ফির অ্যায়সি, হাসি রাত হো না হো …” আতর সেটা দেখে সৌভাগ্যকে বলল— “গানটাকে গান হিসেবেই নিলাম।”
আতর আর সৌভাগ্যের মধ্যে যবে থেকে বেশি কথা হচ্ছে তার দেড় মাসের মাথায় একদিন রাতে সৌভাগ্য বলল— “আতর, আমি তোমার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করি না। শুধু এটুকুই বলতে চাই, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সারাজীবন তোমার ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে চাই।” কথাটা আতরের ঠিক পছন্দ হল না, তাও বলল— “বেশ।”
— “কিন্তু, তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি একজনের নির্দেশে।” আতরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তবুও শান্ত গলায় বলল— “মানে?”
— “বিনীত সরকার।”
— “টাকির সেই বিখ্যাত কবি ও বিজ্ঞানী, যিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন! আমি জানি, তোমার সঙ্গে ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল …”
— “ছিল না, আছে। উনি নিরুদ্দেশ হয়ে যাননি, অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।”
— “কীসব বলছ, সৌভাগ্য! তোমার মাথা গেছে না আমার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
— “লকডাউনের মধ্যেই উনি আমায় দেখা দিয়েছিলেন। বিষয়টা গোপনীয়। তুমি কাউকে কিছু বলবে না।”
— “উনি তবে হারিয়ে যাননি?”
— “সবটা আমি বলতে পারব না।”
— “উনি কী চান?”
— “আমি জানি না, আতর। উনি বলেছিলেন তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে।”
আতর ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়ে বলল— “উনি না বললে, তুমি আমার কাছে আসতে না?”
— “সাহস হত না, আতর।”
— “এরপর?”
— “তুমি কী চাও?”
— “নিশ্চই তোমাকে বিয়ে করতে চাই না।”
— “এখানে বিয়ের কথা এল কোথা থেকে? আমি কি তোমাকে কোনো ভাবে আঘাত দিলাম?”
— “না, আমাকে আঘাত দেওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই।” আতর যে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে, সৌভাগ্য বুঝতে পারছে না, কারণ— ওরা তো ফোনে কথা বলছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আতর কোনো ক্রমে বলল— “সরি, আমার এ-ভাবে বলা উচিত হয়নি।”
— “আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু, আমি তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছি না।”
— “জানি, গুরুর আদেশ পালন করছ।”
— “না, তুমি বুঝতে পারছ না, আতর? আমি তোমার মাথাটা আমার বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছি। চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি।” আতরের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
পরের দিন সকালে উঠে সৌভাগ্য আতরকে জানাল, বিনীত সরকার আতরকে ডেকেছেন, খুব জরুরী দরকার। সৌভাগ্য কি বিনীত সরকারকে হ্যালুসিনেট করে! নাকি ভদ্রলোক কোনো কারণে গা-ডাকা দিয়ে আছেন আর লুকিয়ে লুকিয়ে সৌভাগ্যর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু, কেন? আর তাঁর হঠাৎ আতরকে দরকার পড়লই বা কেন? আতর কেন নিজেকে এ-সবের মধ্যে জড়াচ্ছে? কী আছে সৌভাগ্যের মধ্যে? পৃথিবীতে ছেলের অভাব নাকি? সেই মুহূর্তে আতর সিদ্ধান্ত নিল, সে সৌভাগ্যকে ব্লক করবে। আতর এই ছেলেটির প্রতি ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অনুভূতিকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। এমনিতেই আতর অসুস্থ― সে রাত্রিবেলা ভূত দেখে, কাদের যেন কন্ঠস্বর শুনতে পায়, বারবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে, অ্যাসাইলামে থেকেছে, তাকে কড়া কড়া ট্রাঙ্কুলাইজার খেতে হয়! আতর সৌভাগ্যকে ব্লক করে দিল।
ব্লক করে দেওয়ার কয়েক মুহূর্ত পর থেকেই আতরের খুব কান্না পেতে লাগল। ভালো থাকা ওর কপালে নেই। সৌভাগ্যর সঙ্গে কথা বলে ও সুস্থতার দিকে এগোচ্ছিল, ওর দৈনন্দিক কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। ও ভালো থাকছিল। কিন্তু, সৌভাগ্য ওর জীবনে বেশি দিন স্থায়ী হল না। ব্লক করে দিয়েও ও বারবার মোবাইল উল্টে দেখছিল, সৌভাগ্য যদি অন্য কোনো নাম্বার থেকে যোগাযোগ করে। আতর একটা ফেক প্রোফাইল থেকে সৌভাগ্যর ওপর নজর রেখে যাচ্ছিল। কোনো পোস্ট নেই। যত সময় যাচ্ছিল আতরের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছিল। ট্রাঙ্কুলাইজার নিয়েও দু-রাত ঘুম হল না। ও ভূত-প্রেত দেখতে শুরু করেছে। রাতে ভয় পেয়ে চিৎকার করছে। আতর বুঝতে পারছে না, তার এত একা লাগছে কেন, এত বিপন্ন বোধ করছে কেন! সে তো চিরকালই একা! সম্পর্ক থেকে সরে আসা আতরের কাছে কোনো ব্যাপার নাকি? আতর প্রতি মুহূর্তে ভাবছে, এবার হয়তো কষ্ট কমে যাবে, কিন্তু কমছে না।
দুই রাত বিনিদ্র থেকে বেলার দিকে আতর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল দুপুর ১টার সময়। ঘুম ভাঙতেই ফেক প্রোফাইল দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল সৌভাগ্যর ওয়ালে। সেখানে সৌভাগ্য একটি কবিতা লিখেছে—
“তুমি তো কেবল একটি ঘ্রাণ—
ছুঁতে পাব না জেনেও ডুবিয়ে দিয়েছি আঙুল।
তোমার কোনো আকার নেই বুঝে
তোমাকে বাঁধতে চেয়েছি পয়ারে।
পলাশের ঝরে যাওয়া স্বপ্নে, হৃৎপিন্ডের তীব্র ক্ষরণে,
রোদ আর ক্লেদে,
অনুনয়ের গ্লানিতে, ক্লান্তিতে,
ছিন্নভিন্ন আমার বলা হল না আর―
পলাশের কোনো গন্ধ হয় না।
অথবা যেটুকু লেখা হয়ে গেল,
সেই কাগজে, কলমে, ফেলে আসা জন্মে
তুমি রয়ে গেলে, সেটুকু আমার।
আমার সেই তুমিটুকুকে
কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।”
আতরের মনে হতে লাগল, তবে কি সে সৌভাগ্যকে কষ্ট দিয়ে ফেলল! সবটা না শুনে এ-ভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। আতর নিজের অবস্থা বুঝে গেছে, সে সৌভাগ্যকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে, এটা থেকে বেরোনো ওর পক্ষে অসম্ভব। এখন সৌভাগ্যর দিক থেকেও যখন একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তখন এ-ভাবে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না। আতর ব্লক তুলল। সৌভাগ্যকে ছোট্ট করে একটা মিস কল দিল। সৌভাগ্য ফোন করল না। আতর রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত যেন একটা করে প্রহর। বারবার হোয়াটসঅ্যাপ চেক করছে। তারপর ৪৫ মিনিট পর সৌভাগ্য ফোন করল— “আতর, আতর, আতর!”
— “সৌভাগ্য, সৌভাগ্য, সৌভাগ্য।”
— “বলো, আতর।”
— “আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
— “এ-ভাবে বলো না, আতর। দোষ আমার।”
— “কীসের দোষ?”
— “জানি না। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। হাত দুটো ধরতে দেবে, আতর?”
— “দেব তো।”
— “আমার বুকে মাথা রাখবে?”
— “রাখব।”
— “তোমায় চুমু খেতে পারি?”
— “পারো তো।”
সেদিন রাতে সৌভাগ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। লকডাউন চললেও সপ্তাহে তিনদিন সৌভাগ্যকে অফিস যেতে হয়। বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় কালো রেনকোট গায়ে কে একটা ওর সামনে এসে দাঁড়াল। বলল— “আতরকে আনবে কবে?” গলা শুনে সৌভাগ্য চিনল, উনি বিনীত সরকার। সৌভাগ্য উত্তর দিল— “আমায় ক্ষমা করে দিন। আমার দ্বারা হবে না।”
— “কেন? আর শোনো তুমি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করবে না। করোনি তো?”
— “না করিনি। কিন্তু, দেখা করতে বারণ করছেন কেন?”
— “সমস্যা আছে।”
— “কী সমস্যা? দেখা না করে ওকে টাকিতে আপনার কাছে নিয়ে যাব কী করে?”
— “তার জন্য লোক আছে।”
— “মানেটা কী? ওকে দিয়ে হবে-টা কী?”
— “ভালো কাজই হবে। মানুষের কল্যাণের কাজ।”
— “ওকে এ-সব বললে রেগে যায়।”
— “ওকে বোঝাও, সৌভাগ্য। তবে ওর সঙ্গে দেখা করো না। কোনো পরিস্থিতিতেই না। আমি এলাম। ভালো থেকো।”
এরপর চারদিন কেটে গেছে। সৌভাগ্য আর আতরের মধ্যে ফোনে ফোনে অলিখিত প্রেম চলছে, তাও আবার কামগন্ধহীন, বাচ্চাদের মতো। আতর বলছিল— “আমি বলে দিতেই পারি। তোমার সঙ্গে আমার কীসের ইগোর লড়াই? তোমার সঙ্গে আমার তো কোনো লড়াই থাকতে পারে না!” সৌভাগ্য বলল— “কথাগুলো তুমি কাকে বলছ, আতর?”
— “হয়তো নিজেকে। আমার ইগোতে আটকাচ্ছে। তাছাড়া, উচিত নয়।”
— “কী উচিত নয়?”
— “আমার পক্ষে তোমাকে বলা উচিত নয়।”
— “কেন?”
— “তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারব না। আমার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আমি তোমাকে ভুলের পথ দেখাতে পারি না।”
— “আমি তোমার শুধুই বন্ধু। বন্ধুত্বটুকু ছাড়া আমি কী চেয়েছি, বলো।”
এত কিছুর পর শুধুই বন্ধুত্ব। আতরের ভয়ানক কান্না পেল। “ফোন রাখো” —বলে আতর ফোন কেটে দিল। ফেসবুকে গিয়ে চূড়ান্ত পাগলামি করতে শুরু করল। দু-ঘন্টা ধরে একের পর এক আজেবাজে মাথামুণ্ডুহীন পোস্ট দিয়ে সৌভাগ্যের ফোন পেয়ে আবার সে শান্ত হল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে সে ফোন ধরল। সৌভাগ্য এটা-ওটা বলে যাচ্ছে, আতর চুপচাপ শুনছে আর ফেসবুকে গত দু-ঘন্টায় যে-সব পোস্টগুলো করেছিল সে-গুলো ডিলিট করছে। সব ডিলিট করা হয়ে যাওয়ার পর আতর বলল— “আমি এক সময় ভেবেছিলাম, আমি মোট একুশটা প্রেম করব।” সৌভাগ্য বলল— “আচ্ছা! একুশটা কেন?”
— “কারণ, আমি বাংলা ভাষার কবি। একুশের সঙ্গে বাংলা ভাষা তীব্র ভাবে জড়িয়ে আছে।”
— “একুশে ফেব্রুয়ারি! তো একুশটা হয়ে গেছে?”
— “হ্যাঁ।”
— “একুশ নম্বরটা কবে হল?”
— “সম্প্রতি।”
তারপর দুজনেই হা হা করে হেসে উঠল। আরও কিছুক্ষণ অন্য কথার পর সৌভাগ্য বলল— “কতবার ভেবেছিনু” গানটা তোমায় গেয়ে শুনিয়ে ছিলাম মনে আছে? বোঝোনি কিছু? সব কথা মুখে বলে বোঝাতে লাগে?” সেদিন রাত থেকে সৌভাগ্য আতরের সঙ্গে ফোন সেক্স করতে শুরু করল। সৌভাগ্য বলে যাচ্ছে, আতরও শুনে যাচ্ছে আর শিহরিত হচ্ছে। সবটা হয়ে গেলে সৌভাগ্য বলল— “আই লাভ ইউ, আতর।” এ-কথা শোনার পর আতর উন্মাদের মতো বলতে লাগল— “আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি, সৌভাগ্য। পাগলের মতো।”
— “আমার বউয়ের পর এই কথাটা তোমাকেই শুধু বললাম। ভালোবাসি।”
আতর আর সৌভাগ্যের প্রেম জমে উঠেছে। রাতে ফোন সেক্স, দিনে কথা, কখনো কখনো ভিডিও কল। ভিডিও কলটাও বেশ অভিনব― ভিডিও অন করে একে অপরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা, মোবাইলের স্ক্রিনে হাত বোলানো, ফ্লাইং কিস আর স্ক্রিনে চুমু। অফিস থেকে ফেরার পথে সৌভাগ্যর আবার একদিন বিনীত সরকারের সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন— “দেশে প্রত্যেক দিন প্রায় ৯০ হাজার করে করোনা পেসেন্ট বাড়ছে।” সৌভাগ্য বলল— “আমি করোনাকে আর ভয় করি না।”
— “তুমি ভয় না করলে কী হবে? কত লোকের রুজি-রোজগার বন্ধ বলো তো? দেশের জিডিপি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! যাক গে, কাজের কথায় এসো, আতরের কী খবর?”
— “আমি ওকে আর এসব কথা বলি না।”
— “দেখা করেছ নাকি?”
— “না, করিনি।”
— “দয়া করে দেখা কোরো না।”
— “আতরের রহস্যটা কী?”
— “আতর হল এক মহার্ঘ্য আতর। ওর বিনিময়ে আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার নিয়ে আসতে পারি।”
— “মানে কী? আপনার মাথাটা কি সত্যিই গেল? আর শুনুন, আতরের কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না।”
— “তোমার মনে হল কী করে আমি আতরের কোনো ক্ষতি করতে চলেছি?”
বিনীত সরকার হনহন করে হেঁটে বনের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
বাড়ি ফিরে সৌভাগ্য আতরকে বলল— “আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই, কিন্তু, উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”
— “কেন উচিত হবে না?”
— “এই রকম লকডাউন পরিস্থিতিতে তোমাকে বাড়ির বাইরে আসতে বলতে কেমন যেন লাগছে।”
— “আমার কিছু হবে না, সৌভাগ্য।”
অবশেষে একদিন সৌভাগ্য অফিস পালিয়ে আর আতর বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে বেরিয়ে আধ ঘন্টার জন্য দেখা করল। মাস্ক সরিয়ে তারা একে অপরকে দেখল, হাত ধরল, জটিয়ে ধরল, সৌভাগ্য আতরের গালে একটা ছোট্ট করে চুমুও খেয়ে দিল। আতরের কাছে সময়টা যেন থেমে গিয়েছিল।
রাতে বাড়ি ফিরে সৌভাগ্য আতরকে ফোন করে বলল— “আতর, এটা কীসের গন্ধ বলো তো। আমাকে তো ছাড়তেই চাইছে না।” আতর বলল— “মনে হয় শ্যাম্পুর। এই কথাটা আমায় সবাই বলে, কেন জানি না।”
দেখা হওয়ার দু-দিন বাদে এক রাতে সৌভাগ্য মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল। আতরকে ফোন করে বলল— “আমি তোমাকে সারাদিন পাগলের মতো কামনা করেছি। আমি ভয়ঙ্কর নেশা করে আছি।” আতর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল— “বেশ। আমিও তো তোমাকে চাই। তুমি সবটাই পাবে। একটু অপেক্ষা করো।”
— “আমি উতলা হইনি। তুমি আমাকে চাও, আমি তোমাকে চাই —এর চেয়ে বড়ো পাওনা আর কী হতে পারে?”
— “হ্যাঁ, তুমি আমাকে চাও আমি তোমাকে চাই এটা অনেক বড়ো পাওনা। তারচেয়েও বড় পাওয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাস। আমার বিপন্নতা ভয়াবহ। আমি এমন একটা কুয়োয় পড়ে গেছি যে সেখান থেকে আর উঠে আসা যায় না … তাও তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে— “আমার হাতটা ধরো, সৌভাগ্য, আমাকে বাঁচাও।”
— “হাত তো বাড়িয়েই আছি, উঠে এসো। আমার তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
— “কী কথা?”
— “তোমাকে বলা জরুরী বলেই আমি আজ এত মদ খেয়েছি, নয়ত, বলতে পারতাম না।”
কী যেন আশঙ্কায় আতরের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। আতর অধৈর্য হয়ে উঠল। সৌভাগ্য বলে চলল— “আমি তোমার কাছে সৎ থাকতে চাই।”
— “মূল কথায় এসো। আমার প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে।”
— “আমি তোমায় মিথ্যে বলেছি, আতর। দুটো মেয়ে নয়, আমার তিনটে মেয়ের সঙ্গে ইন্টারকোর্স হয়েছে।” আতর মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু, আতর সৌভাগ্যকে কিছুই বুঝতে দিল না। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে বলল— “কী এসে যায়?”
— “আমি তোমার কাছে সৎ থাকতে চাই। কারণ, আমি তোমাকে কামনা করে ফেলেছি। তোমার জানা উচিত। তৃতীয় মেয়েটি বিয়ের পরে আমার জীবনে এসেছিল।”
— “কী হয়েছে তাতে?”
— “বউ এবং সেই মেয়েটি, আমার তখন দুজনের সঙ্গে শারীরীক সম্পর্ক ছিল।”
— “হতেই পারে। তোমার শরীর, তোমার মন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে একজনকে দিলে আরেকজনকে দেওয়া যায় না।”
— “আমি মুখোশের আড়াল থেকে তোমায় পেতে পারব না।”
আতর তখনো কেঁদে চলেছে। রবি ঠাকুর কি এই জন্যে ওই গানটা লিখেছিলেন— “কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারই ঘায়ে”? সৌভাগ্য জানে, সে আতরের একুশতম প্রেমিক। তার মধ্যে চার জনের সঙ্গে আতরের সবকিছু হয়েছে। তাও এই নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়টা আজ সৌভাগ্য আতরের কাছে কনফেস করতে এসেছে, এই কনফেসটুকু করার জন্য সৌভাগ্যকে বেহেড মাতাল হয়ে যেতে হয়েছে। আতর কি এসবের যোগ্য? এই ছেলেটা বড়ো ভালো। মনে মনে আতর সৌভাগ্যকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে।
তার ঠিক একদিন বাদে, কী কথা হতে হতে সৌভাগ্য আতরকে বলল— “তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?” আতর বলল— “আমার স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ, আমি কিছু ভুলি না।”
— “আমি কোন ভুলে যাওয়ার কথা বলছি তুমি বুঝতে পারছ না?”
— “পারছি। এ-সব মিটে গেলে আমি তোমার সঙ্গে আজীবন বন্ধুত্ব রেখে দেব।”
— “তখন তোমায় কী করে পাব?”
— “খুব সোজা। তোমায় বলে দেব কী করে পাবে?”
— “মানে?”
— “মানে আমায় পাওয়া খুব সোজা। যে-কেউ পেতে পারে।”
— “মানে কী?”
— “তবে বলেই দিই। শুরু এইচএস পরীক্ষার পর থেকে। ফাঁকা ঘরে কেউ ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোতে থাকলে আমি বাধা দিতে পারি না। এটা আমার মানসিক রোগ। আমার হাত-পা অসাড় হয়ে যায়। আমার ভালো লাগে না বললে মিথ্যে বলা হবে। আমার অবশ্যই ভালো লাগে, লোভ হয় … এইভাবেই আমার এতগুলো সম্পর্ক। এক সম্পর্কে থাকতে থাকতে আমার আরো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমি নিজেকে আটকাতে পারি না। সবার সঙ্গেই আমার অল্প-বিস্তর শারীরীক সম্পর্ক হয়ে যায় … বাসে-ট্রেনে কেউ অসভ্যতা করতে এলে অবশ্য সেটা অন্য ব্যাপার। তখন প্রতিবাদ করতে পারি। রেগে যাই। কতবার কত জনকে মারধোর করেছি …”
— “ঠিক আছে আতর, এ-সব তো অতীত।”
— “শোনো আরো কথা আছে। আমার নিজের কাকার সঙ্গেও এইরকম ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। এক রাতের জন্য। সবটা নয় অবশ্যই। তবে অনেক কিছু ঘটে যাবার পড়ে আমি বাধা দিতে পেরেছিলাম। আমার কাকা আত্মহত্যা করেছিল।”
— “শান্ত হও, আতর।”
— “আমার কোনো মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ আর অবশিষ্ট নেই। আমি অপরাধবোধে ভুগি না। আমি কী কী করেছি তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই।”
— “আতর, আর কখনো এরকম কোরো না।”
আতর চুপ করে রইল।
পরদিন রাতে সৌভাগ্য যখন অফিস থেকে ফিরছে, বন থেকে বিনীত সরকার বেরিয়ে এলেন। সৌভাগ্যকে বললেন— “তোমার ব্যাপারটা কী? তুমি কি আতরের সঙ্গে দেখা করেছ?”
— “করেছি।”
— “সেই আমার কথা অগ্রাহ্য করলে!”
সৌভাগ্য উত্তর দিল না। বিনীত সরকার আবার বললেন— “ওকে নিয়ে কাল টাকিতে এসো। বাড়িতে, আমার সিক্রেট চেম্বারে। একটা গাড়ি ভাড়া করে নিও। টাকা আমি দিয়ে দেব।”
— “টাকাটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু, আমি আতরকে কোনো বিপদের মধ্যে ফেলতে চাই না।”
— “তুমি আমাকে এই চিনলে?”
— “ভয়ের কিছু নেই তো?”
— “না। একেবারেই না। আতরকে ফোন করো এখনি। ও আসতে পারবে কিনা জানাও।”
সৌভাগ্য আতরকে ফোন করে বলল— “কাল আমার সঙ্গে টাকি আসতে তোমার আপত্তি আছে?” আতর বলল— “তোমার সঙ্গে জাহান্নমে যেতেও আমার আপত্তি নেই।”
— “কাল সকাল দশটা নাগাদ তাহলে রেডি হয়ে থেকো। বাড়িতে কী বলবে?”
— “আমার বাড়ির কথা আমাকে ভাবতে দাও। তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।” সৌভাগ্য ফোন কেটে দিল। বিনীত সরকার বললেন— “তাহলে ১টা-দেড়টা নাগাদ তোমারা পৌঁছাচ্ছ?” সৌভাগ্য বলল— “হুঁ।”
সৌভাগ্য রাতারাতি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলল। পরদিন কোলকাতায় গিয়ে আতরকে গাড়িতে তুলে নিল। তারপর গাড়ি ছুটে চলল টাকির উদ্দেশে। সৌভাগ্যর খুব ইচ্ছে করছিল, আতরকে আদর করতে। আতরেরও ইচ্ছে করছিল। কিন্তু, সৌভাগ্যর পাড়ারই গাড়ি। কিছুই করা যাবে না। শুধু ওরা একে অপরের হাতটুকু ধরে থাকতে পেরেছিল।
গাড়ি থেকে নেমে ওরা বিনীত সরকারের বাড়ির মধ্যে ঢুকল। চতুর্দিকে জঙ্গল হয়ে আছে। সৌভাগ্য সব চেনে। আতরকে নিয়ে এল বাড়ির পিছনে। পিছনের উঠোনের একটা সিমেন্টের স্ল্যাব সরাতেই সিঁড়ি দেখা গেল। আতর আর সৌভাগ্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। আতর দেখল, ওরা নেমে আসার পর স্ল্যাবটা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। আতর সৌভাগ্যর হাতটা শক্ত করে ধরল। সৌভাগ্য বলল— “কোনো ভয় নেই। আমি তো আছি।” সামনে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে― সম্ভবত কেরোসিন ল্যাম্প। ঘরের সামনে এসে সৌভাগ্য ডাকল— “বিনীতদা, বিনীতদা, আতর এসেছে।” কিছুক্ষণ বাদেই ভেতরের আরেকটা ঘর থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বিনীত সরকার। একটা বেঞ্চ দেখিয়ে দিয়ে বললেন— “বসো তোমরা।” নিজেও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। আতর নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে বিনীত সরকারকে নিয়ে এত খোঁজাখুঁজি, তিনি কিনা নিজের বাড়ির পাতালঘরে লুকিয়ে আছেন! সৌভাগ্য বলল— “আতরকে কী বলবেন বলেছিলেন?” বিনীত সরকার বললেন— “সেটা আমি আতরকেই বলব। তুমি বরং ওপর থেকে একটু ঘুরে এসো।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌভাগ্য “ঠিক আছে যাচ্ছি”— বলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। স্ল্যাব বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হল। বিনীত সরকার বলতে শুরু করলেন— “শোনো মা আতর, তোমার শরীরের একটা ঘ্রাণ আছে। মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ। যে ঘ্রাণ তুমি জিন মিউটেশনের ফলে পেয়েছ।” আতর কোনো কথা না বলে বড়ো বড়ো চোখ মেলে সব শুনছে। বিনীত সরকার বলতে থাকলেন— “এই ঘ্রাণ সকলকে তোমার দিকে টেনে আনে। তুমি প্রেমের প্রতিমা। শুধু মানুষ নয় তোমার প্রতি অন্য জগতের জীবরাও আকর্ষণ অনুভব করে।” আতর এবার মুখ খুলল— “অন্য জগতের মানে?”
— “মানে ভূত-প্রেত-ঈশ্বর-এলিয়েন। তুমি তাদের দেখতে পাও না?”
— “পাই। আমি তো ভাবি এটা আমার অসুস্থতা।”
— “না। তুমি লক্ষ্য করোনি যে-পুরুষ তোমার সামনে আসে সে-ই তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে?”
— “পড়ে।”
— “তোমার উপর এলিয়েনদের নজর পড়েছে। তোমাকে তারা তাদের গ্রহে নিয়ে যেতে চায়।”
— “মানে?”
— “পুরোটা শোনো। ওদের গ্রহে প্রেম, ভালোবাসা সব হারিয়ে গেছে। সকলে জলজ্যান্ত রোবটে পরিণত হয়েছে। ওরা শুধুই কাজ করে। নারী-পুরুষ আর একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। কিন্তু, তোমার ঘ্রাণে ওদের শরীরে উদ্দীপনা জাগছে, ওদের মধ্যে প্রেমের অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে।”
— “ওরা এ-সব জানছে কী করে?”
— “দীর্ঘদিন ধরে তোমাকে ওরা পর্যবেক্ষণে রেখেছে। তোমার কাছে ওরা যায় তো। তুমি অনুভব করতে পার না?”
— “আমি এইসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করি না।”
— “তবে চলো ভেতরের ঘরে।”
— “আমি সৌভাগ্যর কাছে যাব।”
— “ভয় নেই। আমার সঙ্গে এসো।”
বিনীত সরকার দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আতর ভেতরের ঘরে পা দিল। এই ঘরেও অস্পষ্ট আলো। একটা গোল টেবিল। সেটিকে ঘিরে চার-পাঁচটি চেয়ার। পিছনের চেয়ার দুটিতে চোখ পড়তেই আতরের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। কারা এরা! ব্যাঙের মতো চোখ, বিশাল মাথা, লিকলিকে ঘাড়, হাতগুলোও সরু সরু, বুকের হাড় বেরিয়ে আছে। আতরকে দেখা মাত্র তারা কিচিরমিচির কিচিরমিচির করে উঠল। আতর ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেল। বিনীত সরকার বললেন— “ওরা গ্রে-এলিয়েন। তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তুমি তো বহুবার মরতে গিয়েছ। মৃত্যুভয় তো তোমার থাকার কথা নয়। তবে কীসের ভয় পাচ্ছ? চলো, আমার সঙ্গে। ওদের সঙ্গে বসবে চলো।” আতর গুটিগুটি পায়ে বিনীত সরকারের সঙ্গে এগিয়ে গেল, এলিয়েনদের সামনে গিয়ে বসল। বিনীত সরকার বলতে লাগলেন— “তুমি ওদের সঙ্গে গেলে, পৃথিবীর অনেক বড়ো মঙ্গল হবে। ওরা একটা অদৃশ্য মিশাইল ছুঁড়ে সারা পৃথিবী থেকে করোনা বিলুপ্ত করে দেবে বলেছে।”
আতর বলল— “সত্যি?” বিনীত সরকার বললেন— “হ্যাঁ, ওদের সেই টেকনোলজি আছে। আমি বহুদিন এদের সঙ্গে কাজ করছি। ওরা তোমাকে রাজার হালে রাখবে। ওদের গ্রহটা কত সুন্দর তুমি জান না।” আতরের চোখে জল আসছিল, তাহলে সৌভাগ্যকে ছেড়ে চলে যেতে হবে! কিন্তু, এখানে ‘না’ বলার কোনো জায়গা নেই। সারা পৃথিবীর মানুষের ভালোর জন্য আতরকে যদি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়, যাবে। সবার জন্য যদি ওকে বলি-প্রদত্ত হতে হয়, ও হবে। আতর বিনীত সরকারের দিকে তাকিয়ে বলল— “আমি রাজি।” বলতে গিয়ে আতরের গলা বুজে আসছিল, বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। বিনীত সরকার ‘কিচিরমিচির’ ভাষায় এলিয়েনদের সঙ্গে কী যেন আলোচনা করলেন। তারপর আতরকে বললেন― “বাইরে গিয়ে বসো। আমি আসছি।” আতর দরজা ঠেলে বাইরের ঘরে চলে এল। এসে দেখে সৌভাগ্য ফিরে এসেছে। আতর সৌভাগ্যকে দেখে বলল— “আমার আর সময় নেই।” সৌভাগ্য বলল— “কী হয়েছে?” আতর উত্তর দিল না। অনতি বিলম্বকাল পরেই বিনীত সরকার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। এসে চেয়ার টেনে বসে আতরকে বললেন— “সৌভাগ্যকে বলেছ?” আতর মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তখন বিনীত সরকার আতরের শরীরের ঘ্রাণ আর এলিয়েনদের ইচ্ছার কথা সৌভাগ্যকে জানালেন, এও বললেন যে আতর তাতে সম্মতি জানিয়েছে। সৌভাগ্য রেগে উঠল, বলল— “মানেটা কী? আমরা করোনার জন্য এই মেয়েটার জীবন বিপন্ন করতে পারি না।” বিনীত সরকার বললেন— “ওদের কি মানুষ পেয়েছ? সামান্য সুগন্ধির জন্য মানুষ কস্তুরী মৃগ হত্যা করে। ওরা এত অমানবিক নয়।” সৌভাগ্য বলল― “তবে ও একা নয়, আমিও যাব।” আতর এবার মুখ খুলল— “পাগলামি কোরো না। আমার কোনো পিছুটার নেই। কিন্তু, তোমার তো সন্তান আছে, সৌভাগ্য। সে তো তোমার হাতে-পায়ে পড়ে এ-পৃথিবীতে আসেনি। এনেছ যখন, তার দায়িত্ব ফেলে তুমি পালাতে পার না।” সৌভাগ্য বলল— “কারোর কি ছোটোবেলায় বাবা মারা যায় না? তাদের বাচ্চারা মানুষ হয় না?” আতর বলল— “তুমি মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবে?” সৌভাগ্য দমে গেল। বিনীত সরকার সৌভাগ্যের উদ্দেশে বললেন— “জীবনে কখনো কখনো কোনো একদিক বেছে নিতে হয়।” সৌভাগ্য আতরের দিকে তাকিয়ে বলল— “যেয়ো না।” আতর শূন্য দৃষ্টি মেলে কেরোসিনের ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিনীত সরকার বললেন— “এই জন্য আতরের সঙ্গে দেখা করতে বারণ করেছিলাম।” সৌভাগ্য আরও রেগে গেল, বলল— “হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবাসি, সেটা ওর ঘ্রাণের জন্য নয়। ওর সামনে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই বাসি। আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি। আপনি এটা কী করলেন, বিনীতদা?” বিনীত সরকার শান্ত ভাবে বললেন— “বেশ, তবে আতর যাবে না।” আতর বলল— “না, সেটা হয় না। আমি না গেলে পৃথিবী থেকে করোনার অবলুপ্তি ঘটবে না।” বিনীত সরকার বললেন— “তোমাদের তো আগেই বলেছি, ওরা অমানবিক নয়। তোমাদের কষ্ট দিয়ে ওরা কিছুই করতে পারবে না। তুমি ওই ঘরে বসে কান্না লুকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলে। ওরা বুঝতে পেরেছিল। তাই ওরা তোমাকে নিয়ে যাবে না।” আতর বলল— “তাহলে সেই অস্ত্রের কী হবে?” বিনীত সরকার বললেন— “ওদের অদৃশ্য স্পেস স্টেশন থেকে এতক্ষণে হয়তো মিসাইল ছুঁড়ে দিয়েছে। কাল থেকে আর একজনও করোনায় আক্রান্ত হবে না।” সৌভাগ্য বলল— “তাহলে আমরা কি এখন মুক্ত?” বিনীত সরকার বললেন— “হ্যাঁ, দুটি শর্ত। এক নম্বর— মুখটি খোলা যাবে না। অবশ্য মুখ খুলেও কোনো লাভ নেই। সব শুনে তোমাদের লোকে পাগল ছাড়া আর কিছু বলবে না। দুই নম্বর— আতরকে এখানে মাঝে মাঝে আসতে হবে। সৌভাগ্য, তুমিও সঙ্গে আসতে পার। ওরা আতরের উপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে, অবশ্যই আতরের কোনো ক্ষতি না করে। যদি ওর শরীরের নির্যাস থেকে কোনো পারফিউম বানানো যায়, তাহলে ওরা বড়ো উপকৃত হবে।” আতর হাসিমুখে বলল— “আমি রাজী।” তারপর দুজনে বিনীত সরকারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বিনীত সরকার দুজনের মাথায় হাত রেখে বললেন— “অভাগা দুটোকে কী যে আশীর্বাদ করি, ভেবে পাই না! একে অপরকে ভালো রেখো আর ভালো লিখো।”
আতর আর সৌভাগ্য হাতে হাত দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। আতর দেখল, স্ল্যাব নিজে নিজে সরে যাচ্ছে, মাটির ওপরে তখন বিকেলের সোনা রোদ। ওপরে এসে আতর বলল— “আর কোনো কথা শুনতে চাই না, সৌভাগ্য, আমার ঠোঁটে চুমু খাও, এখনি।” সৌভাগ্য দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ কপালে তুলে মিটিমিটি হাসতে লাগল।