অশোক ভট্টাচার্য
আজ তিনি বেঁচে থাকলে যে নেত্রীর প্রতি তিনি জীবনের উপান্তে এসে অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন, সেই নেত্রীর উদ্দেশে কী লিখতেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। গত ৮ জুলাই তাঁর প্রয়াণ বার্ষিকী গেলো; সেদিন ব্যস্ত থাকায় লিখে উঠতে পারিনি কিছু…ইদানীং এসব লেখার আগ্রহও ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি, হয়ত চালশে রোগ ক্রমে চেপে বসছে। যা হোক…
“দুটি ঠোঁট শব্দ তুলে অন্য দুটি ঠোঁটে
বলে ওঠেঃ
‘মনে নেই? কাল মধুমাস!’
বলেছিলো আর কেউ আমার মা নন।
বললাম তো কারণ–
মা তখন আমাকে নিয়ে যন্ত্রণায় নীল।।”
— মা যখন যন্ত্রণার বিষে বিষে নীল হন তখন কবিও নীলকন্ঠ হয়ে ওঠেন; এমন কবির নামই সুভাষ মুখোপাধ্যায়।গত ৮ জুলাই। তাঁর মৃত্যু দিবস ছিলো।
“আমার হাতে তো আর কুষ্ঠ হয়নি যে,সবসময়ই হাত মুঠো করে উঁচুতে তুলে রাখতে( পড়ুন রেড স্যালুট) হবে…” –নয়ের দশকের শুরু থেকেই ব্যক্তিগত নানা আলাপচারিতায়,পাঠচক্রে তিনি এমন কথা বলতেন। তিনি, সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
” জোড়া বলদে দেওয়ালে লটকে ঠোঁট চেটে বলে ভোট দে..” –কবির নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আবার এ মানুষটাই ব্রিগেডে রাজীব গান্ধীর স্মরণ সভায় বললেন,” অন্ধ কংগ্রেস বিরোধিতার দিন শেষ হয়ে গেছে..”।
এমন দৃষ্টান্ত নতুন কিছু নয়। সুনীল লিখেছেন, ” প্রিয় ইন্দিরা, বিমানের জানালায় বসে তুমি আর গুজরাতের বন্যা দেখতে যেও না”।
আবার ইন্দিরার মৃত্যুর পর সেই সুনীলই লিখলেন, ” জাতীয় পতাকাই তাঁর শোভা”..। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথাই যদি ধরি…কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মাঠে- ময়দানে গণসংগীত গাওয়া হেমন্ত মুক্তিযুদ্ধের পর ইন্দিরার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইন্দিরাকে দেখে গেয়ে উঠলেন,” ও মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে..”
আসলে শিল্পীকে কেবল শ্রেণি-চেতনার তত্ত্বে যান্ত্রিকভাবে বিচার করাটা কেবল অতি সরলীকরণই নয়; চরম অবৈজ্ঞানিকও বটে।
শিল্পীর শ্রেণি চেতনার প্রভাব প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষভাবে তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিভাত হবেই, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সাহিত্য বিচারের মার্কসবাদী এ ধারাটি যখন যান্ত্রিকতার খোপে আটকে যায়,বিপত্তি ঘটে তখনই।
একটা ঘটনার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়। তেভাগা আন্দোলন তখন পুরোদমে চলছে। বাম নেতা চিন্মোহন( চিনু) সেহনবীশ একদিন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য মানিক বন্দোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন,চন্দনপিঁড়ি যেতে হবে মানিককে এবং গিয়ে সব দেখে শুনে তেভাগা নিয়ে একটা লেখা লিখতে হবে। মানিক সরাসরি না বলে দিলেন। মানিক বললেন,পার্টি বললে তিনি একশোবার যেতে রাজি, কিন্তু তেভাগা নিয়ে লেখার জন্য তিনি চন্দনপিঁড়ি যাবেন না। মানিক গেলেনও না।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। চিনু সেহনবীশ তখন জেলে, জেলের ভিতরেই তাঁর হাতে এসে পৌঁছালো ‘পরিচয় ‘ পত্রিকার একটা সংখ্যা, সেখানে প্রকাশিত একটি গল্পের নাম–” হারানের নাত জামাই “। বাকিটা ইতিহাস।
কথাগুলো বললাম এ কারণেই যে, আমি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরও দেখেছি যাঁরা সত্যিই অগাধ পণ্ডিত…তাঁরাও একটা খোপ থেকে বেরুতে পারতেন না।
‘রেজিমেন্টেশন’-এর এই এক বিপদ।
বিপদটা এত ভয়ঙ্কর যে, এই মানিক বন্দোপাধ্যায়কেও এ বাংলার তথাকথিত প্রগতিশীল সাহিত্য বিশারদরা বেশ কয়েকটা ভাগে কাটাছেঁড়া করতে থাকেন–১) কেবল মাত্র প্রগতিশীল মানিক,২) সোসালিষ্ট মানিক( তখনও পার্টি সদস্য হননি) ৩) পার্টি সদস্য হওয়ার পরের মানিক..ইত্যাদি.. ইত্যাদি।
প্রয়াত অরিজিৎ বাবু। ইংরেজির অধ্যাপক.. বিশিষ্ট নকশাল নেতা একাধারে। কলেজস্ট্রীট ক্যাম্পাসের মূল ফটক থেকে অধ্যাপকদের কী একটা মিছিল ছিলো সেদিন,আমি ক্লাস সেরে নীচে নেমে দেখলাম অনেকের সাথেই অরিজিৎ বাবুও দাঁড়িয়ে। ওঁদের মিছিল শুরু হতে তখনো দেরি। পণ্ডিত মানুষ অরিজিৎ দার ( আমি অরিজিৎ দাই ডাকতাম)সাথে সেদিন সামনের চা’ এর দোকানের সামনে তুমুল তর্ক হয়ে গ্যালো, Buddhadeb Ghosh সঙ্গে ছিলো সেদিন। প্রসঙ্গ – জীবনানন্দ।
অরিজিৎ দার মতো মানুষও রেজিমেন্টের বেড়াজাল টপকাতে পারলেন না। অবলীলায় জীবনানন্দের শ্রেণি অবস্থান বিচার করতে গিয়ে কেবলমাত্র ” সাতটি তারার তিমির “-এর জীবনানন্দকে প্রগতিশীল বলেন অরিজিৎ দা’রা। ওঁদের মত অনেকটা এমন যে, ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্বের আগের জীবনানন্দ কেবল সুখপাঠ্য, তাতে নেই কোনো ইতিহাস ও সমাজচেতনা!
জানি না, অরিজিৎ দা বেঁচে থাকলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কী বলতেন।
বোলপুরে কবি সম্মেলনে জীবনানন্দ সম্পর্কে পরিচয় দিতে গিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ” সব কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি কোনো কিছুরই ভিতরে নেই..সেই নির্জনতম কবি হলেন জীবনানন্দ। ” সুতরাং ‘ তত্ত্বের যান্ত্রিকতা’ ও রেজিমেন্টেশনের বিপদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেও গ্রাস করতে চেয়েছিলো। ‘চেয়েছিলো’ শব্দটা এ কারণে ব্যবহার করলাম,কেননা চাইলেও তা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে গিলে নিতে পারেনি। আর তাই সুভাষ বেঁচে আছেন আজও।
যাঁরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজ বলেন,…” একদা বামপন্থী কবি”( কথাটা ইদানিং ব্যবহৃত হচ্ছে) ; সবিনয়ে বলছি, সেই সব বোদ্ধারা কতটা বামপন্থাকে বোঝেন আর কতটা কবিতা বোঝেন সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ আছে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে জীবনের একটা পর্বে এসে নিজের পূর্বাবস্থান বদল করেছিলেন। হ্যাঁ করেছিলেন। তবে তার শুরু ওই নয়ের দশকের গোড়া থেকেই। কোনোরকম বিভীষিকাময় বিভূষণ কিম্বা রাজ অনুগ্রহের লোভে তাঁর এহেন অবস্থান পরিবর্তন ছিলো না। আমি আমার পরম বন্ধু বুদ্ধদেব ঘোষের( বর্তমানে সি পি এম -এর এক নেতা) সঙ্গে দু- একবার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী গিয়েছিলাম ১৯৯৯-২০০০ সাল নাগাদ। তখন কানে বেশ কম শোনেন। কাগজে লিখে তাঁর সঙ্গে কথা চালাচালি করতে হতো প্রায়। তো..তখনও তিনি বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর( অথচ চরম সি পি এম বিরোধী একই সঙ্গে)।
জানতেন আমি কংগ্রেস দল করি, কোনোদিন কোনো ছুঁতমার্গ দেখিনি যে কদিন গিয়েছি তাঁর বাড়ি।
বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আন্দোলন তাঁকে নাড়া দিয়েছিলো, তিনি তা অকপটে স্বীকারও করতেন৷ তা বলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তৃণমূল সরকার কখনো ক্ষমতায় আসলে তার রাজানুগ্রহের লোভে এমন করছেন,এ কথা তাঁর চরম কোনো নিন্দুকও বলতে পারবেন না।
তাই আজ যাঁরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে শ্রেণি চেতনার সংশয়ের দোলাচলে ভুগে ঢোঁক গেলেন, তাঁদের আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কারোরই হাতে কুষ্ঠ হয়নি যে সব সময়ই হাত মুঠো করে রাখতে হবে।
“দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যান্ত্রিক জড়বাদ হইতে বিভিন্ন “।
ফলতঃ বিপদ টা এগিয়ে যায় আরো গভীরে…শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ার ঐতিহাসিক ভুল হয় বারেবারে…
এতটাই ভুল হয় যে, বাংলার মরদেহ হাইজ্যাক করার কালচার থেকে রেহাই পান না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও; এই হাইজ্যাকেরও সৌজন্যে ছিলো আজকের বাংলার উন্নয়নের সরকারের কাণ্ডারীরা।
কিন্তু আক্ষেপ অন্যত্র; মৃত্যুর পরে যে বুকে জায়গা পাবার কথা ছিলো লাল নিশানের( কেউ দিতে আসেনি) …কে বলতে পারে, সেই বুক থেকে গুমরে ওঠা যন্ত্রণা তাঁর মৃত্যুর পর অস্ফুটে হয়ত বলে চলেছিলো…
” ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে..’