সোমা নাগ :
5ই জুন সকাল থেকেই মস্কোর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সারাদিন মস্কো শহরের কিছু দ্রষ্টব্যস্থান ঘুরে,রাতের ট্রেনে সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওনা হব। প্যানকেক,মধু,ডিমের নানা প্রকারের সুস্বাদু পদ, ফলের রস,বিভিন্ন ধরনের কেক, সসেজ, দুধ-কর্নফ্লেক্স, চা-কফি, ফ্রুট-ইওগার্ড -এমনকি বিভিন্ন প্রকারের মাছ ও মাংসের এলাহি আয়োজনে ভরপুর প্রাতরাশ সেরে সকাল 9টার মধ্যে সকলে বাসে উঠে পড়লাম।মস্কোর স্থানীয় ট্যুর গাইড রোজি জানালেন,সেদিন আমাদের প্রধান দ্রষ্টব্য–ক্রেমলিন দূর্গ ও প্রাসাদ চত্বর। বাসের মধ্যেই ও আমাদের প্রত্যেকের কাছে এসে দিয়ে গেল এক বিশেষ ধরণের শ্রবণযন্ত্র যাতে,আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও ওর ধারাবিবরণী শুনতে কোনো অসুবিধা না হয়। বাসে বসেই ক্রেমলিন সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য দিলেন রোজি।
দক্ষিণে মস্কোভা নদী,উত্তরে সেন্ট ব্যাসিল’স ক্যাথিড্রাল, পূর্বে রেড স্কোয়ার আর পশ্চিমে আলেকজান্ডার গার্ডেন পরিবেষ্টিত সুবিশাল ক্রেমলিন চত্বর রাশিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসের বহু উত্থান পতনের সাক্ষ্য বহন করছে। ‘Kremlin ‘ শব্দের অর্থ ‘fortress insid a city’.14শ শতক পর্যন্ত এটি Grad of Moscow ‘ নামে পরিচিত ছিল। প্রথমদিকে এর অভ্যন্তরের ওক কাঠ নির্মিত প্রাসাদ ও ক্যাথিড্রালগুলি মঙ্গোলিয়ানদের একাধিকবার আক্রমণে ভস্মীভূত হয়। তৃতীয় গ্র্যান্ড প্রিন্স ইভান ক্রেমলিনের সংস্কার সাধনের কাজ শুরু করেন।পরবর্তীকালে ক্রেমলিনের 3টি ক্যাথিড্রালসহ মোট 6টি ভবন চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত হয়। পৌঁছলাম ক্রেমলিনের সামনে। বাস থেকে নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। ছাতা-শ্রবণযন্ত্র-ক্যামেরা সামলে রোজিকে অনুসরণ করলাম।
ঐতিহাসিক ক্রেমলিন চত্বরে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই পায়ে হেঁটে একটি সেতু পার হতে হবে,যার নীচ দিয়ে অতীতে নদী প্রবাহিত হতো। এখন আর সেই নদীর অস্তিত্ব নেই। সেতুটি ক্রেমলিনের অভ্যন্তরে প্রবেশের মূল ফটকে গিয়ে শেষ হয়েছে । ফটকের দুই পাশে প্রহরারত মিলিটারি রয়েছে । ভিতরে ঢুকেই যে ভবনটি চোখে পড়ে,তার নাম Palace of Congresses — এটি সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কনফারেন্স হল ছিল। হলটির ঠিক বিপরীত দিকে একটু এগোলেই Kremlin Senate -1918তে সোভিয়েত সরকার পেট্রোগার্ড থেকে মস্কোতে এলে,লেনিন এটিকে নিজের বাসভবন রূপে নির্বাচন করেন। কনফারেন্স হলের ঠিক বাঁ দিকের ভবনটি ছিল জোসেফ স্তালিনের বাসভবন । কনফারেন্স হলের ডানদিক দিয়ে একটু এগোলেই চোখ পড়বে রাশিয়ার জার সামরিক শক্তির প্রতীক কারুকার্যমণ্ডিত কামানসমূহ, যা ‘Tsar Canon ‘ নামে পরিচিত। ঠিক পাশেই অবস্থান করছে ক্রেমলিনের সর্বোচ্চ ভবন ‘Ivan the Great Bell Tower’. এই ভবনটিতে 21টি ঘন্টা ছিল,যা জার আমলে শত্রু আগমনের সংবাদে একসঙ্গে বেজে উঠতো। বেল টাওয়ারটির কাছেই মাটিতে গ্রানাইট পাথরের ওপর বসানো রয়েছে বিখ্যাত ‘জার বেল ‘(Tsar Bell). এটির আকার-আকৃতি বিস্ময়কর । রাশিয়া জয়ের স্মারক হিসেবে নেপোলিয়ান এটিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু 6.14 mt.উচ্চতা এবং 6.6mt ব্যাসবিশিষ্ট এই ঘন্টাটিকে কোনোভাবেই স্থানচ্যুত করা সম্ভব হয় নি।ঘন্টাটির একদিকের কিছুটা অংশ ভেঙে গিয়েছিল , এর কারণ হিসেবে নানা মতপার্থক্যও রয়েছে ,তবে মনে করা হয় আগুনে পুড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে রক্ষা করতে প্রচুর জলসহযোগে দ্রুত ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়াকালে ঐ অংশটি ভেঙে যায় । খন্ডাংশটি পাশেই রাখা আছে।
‘Bell Tower’এর সামনেই অবস্থান করছে’Dormition Cathedral’ সহ আরো দুটি ক্যাথিড্রাল ও দুটি প্রাসাদ ভবন।Dormition Cathedral-এ জার সম্রাটদের রাজ্যাভিষেক হতো। এর অন্দরে ছবি তোলা নিয়মবিরুদ্ধ । ইতালির বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা ফ্রেস্কোর কাজ দেখে চমৎকৃত হতে হয়। 1917- সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালের সমাপ্তি, সেইসঙ্গে জারশাসনের অবসান। 1918এর জুলাই মাসে লেনিনের নির্দেশে সপরিবারে নিকোলাসকে হত্যা করা হয়। 1918 থেকেই ক্রেমলিন বলশেভিকদের শাসনকার্য পরিচালনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ক্রেমলিন সেনেট ভবন,যেখানে ভ্লাদিমির লেনিনের বাসভবন ও কার্যালয় ছিল — সেটি বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় । ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়েই যে ধবধবে সাদা ভবনটি চোখে পড়বে,গাইড জানালেন, অলিম্পিক মেডেল প্রাপ্তির পর এই ভবনেই সরকারি সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
সমস্ত ক্রেমলিন চত্বরটি সুউচ্চ ও সুপ্রশস্ত প্রাচীরবেষ্টিত। এখানে আছে প্রায় 20টি টাওয়ার, যা Kremlin Tower নামে পরিচিত । জার শাসনকালে এই টাওয়ার গুলির মাথায় সোনার ঈগল বসানো ছিল। কিন্তু বলশেভিক শাসনপর্বে জোসেফ স্তালিন যখন জারদের বিশ্বাসের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিলেন, তখন ‘Golden Tsarist Eagle’-এর পরিবর্তে ‘ Shining Soviet Stars’ স্থাপন করেন। তবে ক্রেমলিন চত্বরের সবথেকে আকর্ষণীয় ভবনটি হল- The Grand Kremlin Palace. বহুমূল্যবানদ্রব্য সমাহারে সজ্জিত এই ভবনটি সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বাসভবনে পরিণত হয়েছে । 1991সালে ক্রেমলিন ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়।
ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল- Novodevichy Cemetery। আন্তেন চেখভ, নিকোলাই গোগল,ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কি, কনস্ট্যানটাইন স্ট্যানিস্লাভস্কি, বরিস ইয়েলেৎসিন-প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাধিস্থল এটি।
এরপর বাসে বসেই সঙ্গে আনা কিছু খাবার দিয়ে মধ্যাহ্ন আহার সেরে নিলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। বাস একটি মেট্রো স্টেশনের সাবওয়ের মুখে আমাদের নামিয়ে দিল। রাশিয়ার মেট্রো স্টেশন কিন্তুভ্রমণাথীর্দের অবশ্য দ্রষ্টব্য বিষয় । অধিকাংশ মেট্রো স্টেশন রাজপ্রাসাদের মতোই সুদৃশ্য মার্বেল পাথরের কারুকার্যমণ্ডিত এবং দেওয়ালগাত্রের ফ্রেস্কোচিত্রগুলি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়পর্বের কাহিনী প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, মেট্রো স্টেশনের দ্রুততম চলন্ত সিঁড়ি বা এসকালেটর চড়ার অভিজ্ঞতাও অন্যরকম।পাশাপাশি 5-6টি এসকালেটর অতিদ্রুতবেগে ওঠানামা করছে,অতিসাবধানে ডানদিক ধরে উঠতে হবে, বাঁ দিকটি যারা চলন্ত অবস্থাতেও আরো দ্রুত ওঠানামা করতে চান তাঁদের জন্য ফাঁকা রাখতে হবে। না হলেই সংঘর্ষ অনিবার্য!এক্ষেত্রে আমাদের গাইড ব্যাগ ও পাসপোর্ট সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন,কারণ ভ্রমণাথীর্দের অন্যমনস্কতার সুযোগ নেওয়ার লোকের সেদেশেও কিছু অভাব নেই। আমরা মেট্রোট্রেনে চড়ে একটা স্টেশন গিয়ে আবার অন্য ট্রেনে ফিরে এলাম । মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন লক্ষ্য করলাম–বিদেশের আর পাঁচটা শহরের মতোই মস্কোর জনসাধারণ ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শুধুমাত্র সচেতনই নন, যথেষ্ট যত্নসহকারে মেনেও চলেন। মেঘলা-অপরাহ্নের মিঠেল বাতাস গায়ে মেখে ফিরে এলাম হোটেলে।
ডিনার সেরে রাত্রি 9টায় স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। হাতে তখনও কিছু সময় ছিল। তাই কফি খেয়ে গত দিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা 7টা নাগাদ প্রায় 1কিমি পথ হেঁটে পৌঁছে গেলাম আগের দিনের না দেখা স্মারকস্তম্ভটির কাছে। সোভিয়েত রাশিয়া তৎসহ সারাবিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতীক এই স্মারকস্তম্ভটি।বিরাট স্তম্ভের উপরে এক নারী ওপুরুষের জোটবদ্ধ দু-হাতের শক্তমুষ্ঠিতে ধরা কাস্তে-হাতুড়ি। স্তম্ভের চারদিক ঘিরে বেশ কিছু ভাস্কর্যমূর্তি,যা শ্রমিক-কৃষক-মজুরদের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেছে। স্মারকস্তম্ভের নীচে রয়েছে ভূগর্ভস্থ মিউজিয়াম,যা প্রবেশদ্বারে কমিউনিস্ট পার্টির ধাতব স্মারকচিহ্ন বিধৃত। সোমবার ব্যতীত সপ্তাহের অন্যদিনগুলিতে সকাল10টা থেকে রাত্রি 9টা পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে । সোমবার বন্ধ । দুর্ভাগ্যবশত সেদিন সোমবার ছিল। চারপাশে ব্যস্ত মস্কো শহরের জনজীবন,ছুটে চলেছে অজস্র গাড়ি– অথচ মাঝের ঐ স্মারকস্তম্ভটি ঘিরে থাকা চত্বরটি কি অসম্ভব শান্ত। একজন রক্ষী ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। মুগ্ধতার রেশ নিয়ে বেশকিছু সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম একাই। শেষে সেই বৃদ্ধ রক্ষীটির ডাকে সম্বিত ফিরলো। আমাকে স্মারকস্তম্ভের সামনে দাঁড় করিয়ে সে নিজের থেকেই আমার ক্যামেরায় কয়েকটি ছবি তুলে দিল। হাসিমুখে তাকে বিদায় জানিয়ে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম।
ডিনার সেরে কসমক হোটেল থেকে বিদায় নেবার আগে মস্কোর বিখ্যাত মাথ্রুস্কা পুতুল,সেন্টব্যাসিলির মডেল ম্যাগনেট কিনতে ভুললাম না। কাছেই মস্কো রেলস্টেশন । চমৎকার সুসজ্জিত ট্রেনটিতে, টুকটুকে লাল গদিমোড়া শয্যা। এক-একটি কুপে চারজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে । রাত্রি 10-40এ ট্রেন পাড়ি দিল সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে। গত দুদিনের মস্কো শহর ভ্রমণের স্মৃতি সযত্নে আগলে রাখতে ডায়রী-কলম খুলে বসলাম।
ক্রমশ
খবরের ভেতরেও থাকে খবর। সেই খবর সহজে পেতে ডাউনলোড করুন channelhindustan – এর ফ্রি অ্যাপ নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে।
https://play.google.com/store/apps/details?id=mk.droid.channelhindustan
আরও পড়ুন :-
রাশিয়ায় রাশিয়ান সার্কাসের টিকিটের দাম জানেন? মস্কো ঘুরে এসে লিখছেন সোমা নাগ। আজ দ্বিতীয় পর্ব