সোমা নাগ :
পর্ব দুই– রেড-স্কোয়ার থেকে ফেরার পথে দেখলাম Cathedral of Christ the Redeemer । মস্কোভা বা মস্কো নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত এই অর্থোডক্স ক্যাথিড্রালটি পুরনো ক্যাথিড্রালটির নবতম সংস্করণ । পুরনোটি 1883তে জার শাসনকালে নির্মিত হলেও 1931এ স্তালিনের নির্দেশ অনুসারে তা ভেঙে দেওয়া হয় । উদ্দেশ্য ছিল ‘প্যালেস অফ সোভিয়েত ‘ নির্মাণ করা। সেইমতো কাজ শুরু হলেও 1937এ নাৎসি জার্মানির আক্রমণে কাজ স্থগিত হয়ে যায় । সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর 1995 সালে ক্যাথিড্রালটির পুনর্নিমাণ শুরু হয়ে 2000 সালে তা সম্পূর্ণ হয়। এর সোনার পাতে মোড়া গোম্বুজটি দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এরপর কিছুটা সময় কাটালাম Arbat street-এ। সেদিন ছিল রবিবার । ছুটির দিনে মস্কোবাসী এখানকার ফুটপাত রেস্তোরাঁয় সপরিবারে খাওয়া-দাওয়া করতে আসেন । চওড়া রাস্তার মাঝ বরাবর সুদৃশ্য ফুলের গাছ ঘিরে বসবার জায়গা করা আছে। দুপাশে সার বেঁধে থাকা সুসজ্জিত দোকানে মনের মতো উপহার সামগ্রী পাওয়া যায় । বেশ কিছু শিল্পী নিজের হাতে আঁকা ছবির পসরা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন। কোথাও বা বাদ্যযন্ত্রসহ মিষ্টি সুরে গান ধরেছে কেউ। একজায়গায় দেখলাম একজন রমণীর নির্দেশ অনুসারে, এক বিশেষ পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের জন্য, ধীরলয়ের সঙ্গীতের সুরের সাথে অঙ্গ সঞ্চালন করছে কিছু মহিলা। চারপাশের এতো মানুষের মধ্যেও তাঁদের মনোসংযোগের এতোটুকুও ঘাটতি হচ্ছে না,ঠিক যেমন সপ্তাহান্তে দেখা হওয়া প্রেমিক-প্রেমিকা পারিপার্শ্বিককে উপেক্ষা করে পরস্পরে নিমগ্ন,তেমনি । প্রায় প্রতিটি গাছের নীচে বসে থাকা মানুষজন নিজের মতো করে অলস সময় অতিবাহন করছেন। কাছেই ম্যাকডোনাল্ড ,খাবার কিনে খেতে খেতে দ্বিপ্রাহরিক Arbat street -এর বৈচিত্র্যময় জনজীবনের ছবি উপভোগ করতে বেশ লাগলো।
হোটেলে ফিরে আমাদের দলের কিছু সদস্য বলশয় ব্যালে এবং কিছুজন রাশিয়ান সার্কাস দেখতে গেলেন । ব্যালে এবং সার্কাসের টিকিটের আনুমানিক খরচ যথাক্রমে 200-250 ইউরো এবং 60 ইউরো। প্রসঙ্গক্রমে বলি, রাশিয়ার মুদ্রার নাম রুবল। এক ইউরো = 8 কোথাও বা 9 রুবল পেয়েছি আমরা। যাইহোক,আমি ঐ দুই দলের কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে, ক্যামেরা নিয়ে পায়ে হেঁটে মস্কো শহরটাকে নিজের মতো করে ঘুরবো বলে বেরিয়ে পড়লাম । আমাদের দলের পরিচালিকা শ্রেয়সীর কাছ থেকে আশেপাশের দ্রষ্টব্য সম্পর্কে একটু ধারণা নিয়ে নিলাম । আর সঙ্গে নিলাম হোটেলের একটা কার্ড ।
কসমস হোটেলের ঠিক বিপরীত ফুটপাতে মেট্রো স্টেশন । সাবওয়ে দিয়ে ওপারে গিয়ে মেট্রো স্টেশনের পাশ দিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখি ‘ মস্কো স্পেস পার্ক ‘। সবুজে ঘেরা এই পার্কে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো এক বিশিষ্ট ব্যক্তির মূর্তি । মস্কোবাসী এক যুবককে জিজ্ঞেস করাতে সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানালো, মূর্তিটি Konstantin Eduardovich Tsiolkovsky ‘র, যিনি, একজন সোভিয়েত রকেট বিজ্ঞানী এবং অ্যাস্ট্রোনাটিক থিওরির অন্যতম পথিকৃৎ। মূর্তির ঠিক পিছনেই রয়েছে ‘Memorial Museum of Cosmonautics’। এখানে স্পেস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, মডেল, সোভিয়েত রাশিয়ার স্পেস গবেষণার অগ্রগতির ইতিহাস,প্রযুক্তি ,বিশেষত য়্যুরি গ্যাগরিনের স্পেস অভিযানের কাহিনী মডেল সহযোগে প্রদর্শিত হয়। 1981সালে য়্যুরি গ্যাগরিনের স্পেস অভিযানের 20 বছর উদযাপনের দিনে এই মেমোরিয়াল মিউজিয়ামটির উদ্বোধন ঘটে। এর আকাশচুম্বি মনুমেন্ট টাওয়ারটির গঠন বেশ দৃষ্টি আকর্ষক। মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্য 150 রুবল।
মিউজিয়াম দেখে গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়লো দূরে এক সুউচ্চ কারুকার্যমণ্ডিত তোরণদ্বার। কৌতুহলবশত প্রায় কিলোমিটার খানেক পথ হেঁটে সেখানে পৌঁছে জানলাম, ওটি , All Russian Exhibition Centre ,যার পোশাকি নাম VDNKH(ভেদেনখ্) ,তার প্রবেশতোরণ। এটি রাশিয়ার বাণিজ্য প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং একইসঙ্গে প্রমোদউদ্যান। এখানে প্রবেশ করেই, নানারঙের অজস্র টিউলিপ ফুলের সম্ভার দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেল । ইচ্ছেমতো, অগুণিত ছবি তুললাম। সুবিস্তৃত এই ক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে রয়েছে Central Pavilion, যার সামনে লেনিনের বিরাট মূর্তি । সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে আলাপ হল বাংলাদেশের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে । দীর্ঘদিন ধরে তিনি মস্কোশহরে বসবাস করছেন এবং ওনার গবেষণার বিষয় এই VDENKH। কলকাতা থেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসেছি শুনে উনি বিশেষ উৎসাহ সহকারে আমাকে সমস্ত জায়গাটি ঘুরে দেখালেন। Central Pavilion এর ঠিক পিছনেই দেখলাম — ‘People’s Friendship Fountain ‘। এটি ‘Friendship of Nations of the USSR’ বা ‘Friendship of people’s of the USSR ‘ নামেও পরিচিত । সোভিয়েত রাশিয়ার এক দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসকে ধারণ করে রয়েছে এই ঝর্ণাটি। ভদ্রলোক জানালেন,সোনার পাতে মোড়া তামার তৈরি 15টি নারীমূর্তি,যেগুলি ঝর্ণাটিকে ঘিরে আছে, সেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত 15টি দেশের প্রতীক ।
সারা পৃথিবীর কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় পরিচয় ও ঐক্যবদ্ধতার নিদর্শনস্বরূপ এই ঝর্ণাটি নির্মিত হয়। অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি দেশের সরকারি দপ্তর ঝর্ণাটির চারিদিকে ঘিরে অবস্থান করছে।