ঝড়ের ঠিকানা – পর্ব ১০
সঞ্জয় সিংহ :
(জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) :
পি ভি নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদস্য ছিলেন ১ বছর ৫ মাসের জন্য। কিন্তু ব্রিগেড বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে সেই মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে কেন তিনি চলে এলেন তার ব্যাখ্যা মমতাদি দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ব্রিগেডের সমাবেশে যে বিপুল সংখ্যায় মানুষ এসেছিলেন তাঁরা সিপিএমের হাতে অত্যাচারিত ছিলেন। তাঁরা সেদিন ব্রিগেডে এসেছিলেন প্রাণের টানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভালবেসে। ওই সময়ে মন্ত্রিত্বের জন্য দিল্লিতে বসে থাকা মানে মানুষের বিশ্বাস-ভালবাসাকে অমর্যাদা করা বলে তিনি মনে করেছিলেন।
এটা তো গেল তাঁর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। কিন্তু একটা দার্শনিক ব্যাখ্যাও ছিল। মমতাদি পরে বলেছিলেন, “নিজেকে পরীক্ষা করার দরকার ছিল। মুকুট পরা সোজা। কিন্তু তা ত্যাগ করা কঠিন। শুধু ক্ষমতা ভোগ করা নয়। প্রয়োজনে তা ছাড়তেও শিখতে হয়।” মূলত এই দার্শনিক ‘উপলব্ধি’ থেকেই ১৯৯২তে মমতাদি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়লেন সিপিএম বিরোধী আন্দোলনের গণজোয়ারে।
এইসময়ে একটা ব্যাপার লক্ষ করছিলাম, সিপিএমের কট্টর বিরোধিতা করলেও, অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বটেই, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের (অবশ্যই সিপিএম নয়) একাংশের সঙ্গে মমতাদি সখ্য গড়ে তুলছেন। পঞ্চান্ন গ্রামের পঙ্কজ মাখাল, বেলেঘাটার মন্টু সান্যাল বা সাংসদ রাধিকারঞ্জন প্রামাণিকদের মতো ‘বিক্ষুব্ধ’ সিপিএম নেতাদের সঙ্গে তিনি যেমন যোগযোগ তৈরি করেছিলেন, তেমনই ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মমতাদির একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। মমতাদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীনই ‘সবুজ বাঁচানো’র আন্দোলনে নেমেছিলেন। তখন থেকেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মমতাদির ডাকে বিভিন্ন সভা সমাবেশে দেখা যাচ্ছিল। ২১ জুলাই আন্দোলনের পরে মমতাদি ‘২১ জুলাই শহীদ স্মারক তহবিল’ গঠন করেন। সেই কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন সুভাষবাবু। মূলত তাঁরই পরামর্শে মমতাদি মহারাষ্ট্রের ভূমিকম্পে সেখানকার দুর্গত মানুষদের ত্রাণে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর মমতা-প্রীতি নিয়ে সুভাষবাবু অবশ্য ‘কমরেড’দের বিস্তর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু মমতার মধ্যে তিনি একটা ‘স্ফুলিঙ্গ’ দেখেছিলেন। সেইসময় বাম রাজত্বে নানা দুর্নীতি এবং কয়েকজন বাম নেতার বিচ্যুতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন বামপন্থী কবি। মমতাদি যে ‘বাংলায় পরিবর্তন’ আনতে পারবেন তা সুভাষবাবু বিশ্বাস করতেন। সম্প্রতি সুভাষবাবুর ওপর কবি জয় গোস্বামীর একটা লেখা পড়ছিলাম। সেই লেখায় জয় লিখেছেন— সাদা শাড়ি পরা একজন মেয়েকে তিনি সুভাষবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন। সুভাষবাবু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন
“চেনো মেয়েটিকে?’ আমি বলি, কাকে? ওই যে বেরিয়ে গেল? কালীঘাটে থাকে। চেনো না?
আমি বলি, না তো!
ম-ম-তা! খুব তেজি মেয়ে। জানো তো।
আমি বলি, তা-ই?
সুভাষদা অন্যমনস্ক হয়ে যান একটু। বলেন। ও… পারবে।
ও ঠিক পারবে! দেখো তুমি।”
বামপন্থী কবি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন? কারণ, এই ঘটনা নয়ের দশকের। পরবর্তী কালে সুভাষবাবুর মৃত্যুর পরেও তাঁর স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখাশুনো করতে প্রায়ই মমতাদিকে তাঁদের বাড়িতে যেতে দেখেছি।
শুধু সুভাষবাবু বা রাধিকারঞ্জনবাবু অথবা মন্টু সান্যালই নন, ঘটনাচক্রে নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় (কমরেড কাকা) কেও মমতাদি তাঁর আন্দোলনে শামিল করেছিলেন। এমনকী, একবার বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সমর্থনে কমরেড কাকা প্রার্থীও হয়েছিলেন। বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে মমতাদির সোজাসাপটা উত্তর ছিল, “সব বামপন্থী তো খারাপ নন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে কেউ যদি আমার লড়াইয়ের সাথি হন, তাহলে আমার আপত্তি থাকবে কেন?”
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তো মমতাদির সঙ্গে পূর্ণেন্দু বসু, দোলা সেন, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দত্ত প্রমুখ বামপন্থীদের আনাগোনা দেখেছি। এক বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সম্পাদক ঠাট্টা করে বলতেন, “মমতা আসলে বামপন্থী।”
মমতাদি সেইসময় মনে করতেন, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করাটা কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই ভুলে গিয়েছেন। তাই, তাঁর পাশে এগিয়ে আসা বামপন্থীরাই তখন বড় ভরসা হয়ে উঠেছিলেন। আর বাংলায় বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটাতে আন্দোলন ছাড়া যে পথ নেই তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই বুঝতেন। তবে ১৯৯২ সালে ব্রিগেডে বামফ্রন্টের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজানোর পরেই, তিনি জ্যোতি বসুর নির্বাচনী কেন্দ্র দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাতগাছিয়ায় ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর বা কংগ্রেসের কপাল খারাপ। আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠেছে সেইসময়ই ঘটে গেল আযোধ্যা কাণ্ড।
বামফ্রন্ট বিরোধী আন্দোলনে জল ঢেলে দিল আযোধ্যা কাণ্ড। তারপর কীভাবে আবার বাংলায় নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করলেন এবং মমতাদি আবার কেন্দ্রীয় সরকারে ঢুকলেন তা পরের বার জানাব।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন :-