সুমন ভট্টাচার্য
সবসময় কালো পোষাক পরা একটা লোকের মন যে এত সাদা হয়, তা ওয়াসিম কাপুরের সঙ্গে আলাপ না হলে জানতেই পারতাম না|
প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের ফুটপাথে একটা ঝগড়া দিয়ে আলাপ| ঝগড়া থামাতে এবং আমাদের শান্ত করতে ওয়াসিম দা ওনার বাড়িতে বিরিয়ানি আর ফিরনির নিমন্ত্রণ করেছিলেন| সেই নিমন্ত্রণের সূত্রে আনন্দবাজার পত্রিকা ভবনের গায়ে লাগোয়া ওঁর ফ্ল্যাটে প্রথম যাওয়া| পরের প্রায় তিন দশক ধরে যখন যে অনুরোধ নিয়ে ওয়াসিম কাপুরের ফ্ল্যাটে গিয়েছি, দরাজদিল অভ্যর্থনা পেয়েছি| সেই অনুরোধ, তাঁর কাজ মানে শিল্পকলা সংক্রান্ত হোক কিংবা প্রতিবাদ আন্দোলনে হাজির থাকার আব্দার! লখনৌ থেকে কলকাতায় থাকতে চলে আসা পরিবারের সূ্ত্রে ওয়াসিম কাপুর সেই ভারতবর্ষে বিশ্বাস করতেন যে দেশে ধর্মবর্ণ বা কোনও কিছু বৈষম্য তৈরি করতে পারে না|
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এবং ফ্যাসিবাদের প্রতিবাদে একটা আর্ট ক্যাম্প আর অনুষ্ঠানের জন্য একদিন ওয়াসিম দার ফ্ল্যাটে গিয়েছি| অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা শবনম হাশমি, মানে সফদর হাশমির বোন আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন| ওয়াসিম দা সেইদিন তাঁর গল্পের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন| দুই পরিবারের অতীত, আইপিটিএ-র সঙ্গে যোগাযোগ, শাবানা আজমির বাবা কাইফি আজমি বা সাত হিন্দুস্তানির পরিচালক খাজা আহমেদ আব্বাসের মতো চরিত্রদের নিয়ে গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম| প্রথমদিন ওঁর খাওয়ানো ফিরনি আর শাহি টুকরার মতোই মিষ্টি
ছিল ওয়াসিম দার গল্পগুলো|
আসলে এটাই ওয়াসিম কাপুর| কোনও মালিন্য নেই| সবসময় অন্যদের সাহায্যের কথা ভাবছেন| প্রতিবাদ সমাবেশে কবিতা পড়ানোর জন্য তিনি যে বামনেত্রীর নাম হয়তো সুপারিশ করেছেন, তিনি পরে তারকা হয়েছেন, কিন্তু ওয়াসিম দার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই| নিজের কাজে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নিমগ্ন| এতটাই গভীর ছিল তাঁর শিকড়, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস|
ওয়াসিম কাপুর চলে যাওয়ার দিনে এত হুড়মুড় করে স্মৃতি ভিড় করে আসছে| প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে চাকরি করার সময় ওয়াসিম দার সঙ্গে যখন আমার ঘনিষ্ঠতা তুঙ্গে, একদিন এক সিনিয়র কলিগ ধরলেন| আমার সেই সিনিয়র সহকর্মী যেমন বিখ্যাত রসিক, তেমনই আইকনিক শিল্প সমালোচক| সেই সিনিয়র কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,ওয়াসিম ওই পোট্রেটগুলো দেখিয়েছে নাকি?
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি দেখে উনি আরও সঙ্গোপনে বললেন, আহা, ও কত নায়ক নায়িকার ছবি এঁকেছে, জানো তো?
তারপরেও কতবার ওয়াসিম দার ফ্ল্যাটে গিয়েছি| ওনার ছবি দেখেছি, কত গল্প শুনেছি| সেলুলয়েডের চরিত্র নয়, হাল্লা বোল আর হাম দেখেঙ্গের মতো শব্দবন্ধ তৈরির অণুগল্পেই বুঁদ হয়ে থেকেছি|