সোমা নাগ :
৩ জুন, ২০১৭, মস্কোর দোমোদেদোভো বিমানবন্দরে যখন নামলাম, রাশিয়ার সময় তখন রাত ৮ টা। ভারতীয় সময়ের তুলনায় আড়াই ঘণ্টা পিছিয়ে । বৃষ্টিভেজা মস্কোর তাপমাত্রা ছিল আট ডিগ্রি । কলকাতার একটি ভ্রমণসংস্থার পরিচালনায় আমাদের ৪৫জনের একটি দল ৩ তারিখ ভোর ৩.৪০ এর বিমানে দোহা, দোহা থেকে পরবর্তী বিমানে মস্কো পৌঁছোলাম। ১৪ দিনের ভ্রমণসূচিতে রয়েছে রাশিয়ার মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ-সহ স্ক্যানডিনেভিয়ার চারটি দেশ— নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ড।
মস্কোর ‘কসমস’ হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। রাশিয়ার স্থানীয় টুর গাইড আশ্বস্ত করল,আগামিকাল আমরা রৌদ্রজ্জ্বল দিন পাব, ভ্রমণে কোনও অসুবিধা হবে না। কসমস হোটেলের অবস্থান এবং ব্যবস্থা বেশ ভাল। নানাপ্রকার সুস্বাদু খাদ্য সহযোগে নৈশাহার সেরে আমার ঘরে এলাম । ২২ তলার ঘর থেকে আলোকোজ্জ্বল মস্কো শহরকে সালংকারা রানির মতো লাগছিল। দু’চোখে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে, দীর্ঘ বিমানযাত্রার ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিলাম অতিকোমল, শুভ্র বিছানায়।
৪ জুন সকালে ৯ মধ্যে প্রাতরাশ সেরে ভলভো বাসে চাপলাম। এক কিমি পথ যেতে-না-যেতেই আমাদের ভ্রমণ পথের সঙ্গী হল— মস্কো নদী, যার নামে এই শহরের নামকরণ। পশ্চিম রাশিয়ায় অবস্থিত, রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কো। চলন্ত বাস থেকেই দেখা গেল, ‘পিটার দ্য গ্রেট ‘-এর মনুমেন্ট। এখানে বাস দাঁড়ানোর নিয়ম নেই, তাই বাস থেকেই ছবি তুলতে হল। বাস গিয়ে দাঁড়াল একেবারে ‘রেড-স্কোয়্যার ‘-এ। এটি মস্কোর, যাকে বলে, ‘ Heart of the city’। এর নাম রেড-স্কোয়্যার হওয়ার পিছনে লাল রঙের ইটের ইমারত বা কমিউনিজমের কোনও সম্পর্ক নেই। রাশিয়ান শব্দার্থ অনুসারে ‘red’ ও ‘beautiful ‘ সমার্থক। তাই একে ‘beautiful square ‘ ও বলা হয়। মূলত এটি বাণিজ্য কেন্দ্র। তবে বিভিন্ন উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিলিটারি প্যারেড, বিক্ষোভ সমাবেশ প্রভৃতি নানাকিছুর জন্য রেড-স্কোয়্যার চত্বরটি ব্যবহৃত হয়। তবে রেড-স্কোয়্যারকে ঘিরে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ইমারত অবস্থান করছে। উত্তর দিকে রয়েছে State Historical Museum, পূর্ব দিকে GUM shopping Centre, পশ্চিমে Kremlin Tower এবং Red Wall এর সামনে Mausoleum of Lenin, আর দক্ষিণে বিখ্যাত St. Basil’s Cathedral। বাইরে থেকেই মিউজিয়াম ও ক্যাথিড্রালের ছবি তুললাম। St. Basil’s এর স্থাপত্যশৈলী অনবদ্য। ১৫৫৫ থেকে ১৫৬১ এর নির্মাণকাল। বহু ধ্বংস, অগ্নিকাণ্ড, দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, কমিউনিজমের সংকটময় কাল পার করে আজও তার বর্ণময় রূপ অম্লান রয়ে গেছে। ১৮১২ সালে নেপোলিয়ান রাশিয়ায় প্রবেশ করে , অন্যান্য ধর্মস্থানের মতো এটিকেও ধ্বংস করতে চেয়েও শেষে আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। স্তালিনও এই ক্যাথিড্রালটিকে অন্যান্য ধর্মীয় স্মারকের মতো ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।
রেড-স্কোয়্যার চত্বরে আমাদের ভ্রমণের মুখ্য আকর্ষণ ছিল Mausoleum of Lenin। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের মমিকৃত দেহ এখানে রাখা আছে। কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত একটি কক্ষে লাল গ্রানাইট পাথরের উপর শায়িত লেনিনের দেহ, যা নিয়মিত গ্লিসারিন, পটাশিয়াম অ্যাসিটেট, কুইনাইন ক্লোরাইডের সাহায্যে সপ্তাহে দু’-তিনবার সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সযত্নে রক্ষিত আছে। ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই সংরক্ষণের ব্যয়ভার সরকার গ্রহণ করত। কিন্তু পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে তা কোনওরকমে চলছিল । ২০১৬-য় সরকারি বাজেটে এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার জন্য ১৩ মিলিয়ন রুবল বরাদ্দ করা হয়। Mausoleum-এ প্রবেশের ক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম অবশ্য পালনীয়— কোনওরকম ছবি বা ভিডিয়ো তোলা, টুপি পরা, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চলা, কথা বলা এবং ধূমপান নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয় যথেষ্ট সিকিয়োরিটি চেকিং-এর পর অনুমতি সাপেক্ষে এই কক্ষে প্রবেশ করা যায়। কিছুক্ষণ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল সময়টা। আকৈশোর ইতিহাস বই আর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে এসেছি লেনিনের কথা, কমিউনিস্ট আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা— আজ তারই প্রাণপুরুষের দেহ শায়িত রয়েছে সামনে, বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি।
লেনিনের মসোলিয়ামের ঠিক পিছনে, রেড ওয়ালের পাশে রয়েছে— জোসেফ স্তালিন, ম্যাক্সিম গোর্কি, ইউরি গ্যাগরিন, জন রিড প্রমুখের সমাধি।
রেড-স্কোয়্যার সম্পর্কে আর কয়েকটি তথ্য দিয়ে আজকের এই পর্বের ইতি টানব। রেড- স্কোয়্যারকে ০ কিমি ধরা হয়। এটিকে মস্কোর সমস্ত রাস্তা, হাইওয়ে, শহরের সূচনাকেন্দ্র বলা হয়। এখানে থেকেই যেন সব ছড়িয়ে পড়েছে। এটি car-free zone। একমাত্র পুলিশ, মিলিটারি, সরকারি আমলা ব্যতীত কেউ গাড়িতে চেপে যেতে পারবে না। এছাড়াও মস্কোবাসীর কাছে রেড-স্কোয়্যারে’র একটা ‘good luck tradition’ আছে। (ক্রমশ)
[ ধারাবাহিক রচনা ]
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন