সুমন ভট্টাচার্য :
সানি লিওনের তখনও জন্ম হয়নি। ভুল বললাম। ইন্টারনেটই-বা তখন কোথায়? সত্তরের দশকের সেই শেষ দিকটাই যৌনতা বা পর্নোগ্রাফি বলতে ছিল কিছু বিদেশি পত্রিকা। আর সুযোগ পেলে বিদেশি সিনেমা। সত্তরের সেই দশকটায় ভারতীয় রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল একটি যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা। পাত্র-পাত্রীর নাম ছিল সুরেশ রাম আর সুষমা রানি। কে ছিলেন এই সুরেশ রাম? তদানীন্তন ভারতবর্ষের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রামের ছেলে। হ্যাঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছেন, এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী মীরা কুমারের ভাই। ১৯৭৮ এর অগস্ট মাসে যখন এই কেলেঙ্কারি প্রথম সামনে আসে, তখন ভারতবর্ষে জনতা পার্টির সরকার। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী, আর সেই মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জগজীবন রাম।
যাঁর দৌলতে এই যৌন কেলেঙ্কারির খবর প্রথম সামনে আসে, তিনি আর কেউ নন, সেই সময়ের দাপুটে রাজনীতিক রাজনারায়ণ। আজকের পৃথিবী তাকে ভুলে গেলেও সত্তরের দশকে রাজনারায়ণ বিখ্যাত ছিলেন খোদ ইন্দিরা গান্ধীকে নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়ার জন্য। রাজনারায়ণ যখন সুরেশ রামের এই ‘কীর্তি’কে মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসছেন, তখন তাকে চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল জগজীবন রাম শিবির। সুরেশ রামের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তিনি এবং তাঁর বন্ধু, সুষমা যখন মার্সিডিজ গাড়ি করে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের জোর করে অপহরণ করা হয়। এবং বেহুশ করে দিয়ে সুরেশ এবং তাঁর বান্ধবীর কিছু আপত্তিজনক ছবি তোলা হয়। সুরেশ রামের এই যুক্তি অবশ্য সেদিন কেউই বিশ্বাস করেনি। রাজনারায়ণ তো পরিষ্কার বলেছিলেন, যে-ভঙ্গিতে ওই ছবিগুলি তোলা, তাতে পাত্র-পাত্রীদের নিজেদের সম্মতি না থাকলে জোর করে ছবি তোলা সম্ভব নয়। সে যাই হোক, জগজীবন রামের পুত্র এবং তাঁর বান্ধবীর ছবিগুলো এতই খুল্লামখুল্লা ছিল, কোনও কাগজই সেই ছবি ছাপার সাহস দেখায়নি। শেষপর্যন্ত সেইসব ছবি ছাপে ‘সূর্য’ নামে একটি পত্রিকা। কারা ছিলেন এই ‘সূর্য’ পত্রিকার মালিক? গান্ধী পরিবার। কে ছিলেন সম্পাদক? সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর দক্ষিণহস্ত বলে পরিচিত, তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকা গান্ধী।
সুরেশ কুমারের এই যৌন কেলেঙ্কারির জন্যই তাঁর আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি, এমনটাই আক্ষেপ ছিল জগজীবন রামের। একজন দলিত নেতা হিসাবে তিনি ভারতীয় রাজনীতির যে-শিখরে পৌঁছেছিলেন, এমনকী মোরারজি দেশাই-এর মন্ত্রীসভায় উপপ্রধানমন্ত্রী অবধি হয়েছিলেন, তাতে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু গান্ধী পরিবার পরিচালিত ‘সূর্য’ পত্রিকার ওই ‘এক্সপোজ’ জগজীবন রামকে প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড় থেকে ছিটকে দেয় এমনটাই আক্ষেপ ছিল বিহারের এই দলিত নেতার।
আজ যখন মীরা কুমার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী, তখনই পুরনো কেচ্ছা টেনে আনার কা্রণ কি? শুধু এইটুকু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, মীরা কুমার যে বলছেন, তাঁর এই লড়াই আদর্শেরই জন্যে, সেটা নিতান্তই বাজে কথা, তা বোঝানোর জন্য। সুরেশ রামের কেচ্ছা গান্ধী পরিবারের পত্রিকা ‘সূর্য’ ছাপার পরে জগজীবন রাম যা যা গান্ধী পরিবার সম্পর্কে বলেছিলেন, তা পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। অতএব, আজকে সনিয়া গান্ধী এবং মীরা কুমার যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আদর্শের কথা বলেন, তখন সেটা ফাঁকা আওয়াজ বলেই মনে হয়।
আরও দুটো বিষয় আজকের ভারতবর্ষকে মনে রাখতে হবে। জগজীবন রামের ছেলে সুরেশ কুমার সেই ১৯৭৮ ই মার্সিডিজ গাড়ি চড়ে ঘুরতেন। অতএব, জগজীবন রামের পরিবার গত চল্লিশ বছর ধরেই দলিত সমাজের ‘ক্রিমি-লেয়ার’-এর মধ্যে পড়েন। তাই মীরা কুমারকে প্রার্থী করে বিরোধী জোট কোনও সত্যিকারের অনগ্রসরকে সামনের সারিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে না। আসলে গেরুয়া শিবিরের দলিত প্রার্থী রামনাথ কোবিন্দ-এর বিরুদ্ধে একটা দলিত মুখ দরকার ছিল। মীরা কুমার সেই ‘যোগ্যতা’য় ফিট করে গিয়েছেন। দ্বিতীয়টা আরও সূক্ষ্ম। মীরা কুমারের প্রার্থীপদকে ‘জাস্টিফাই’ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, এটা আরএসএস-এর আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই। সবাই ভুলে যাচ্ছেন, ৭৭-এর ওই মন্ত্রিসভায় জগজীবন রামের দুই সহকর্মীর নাম ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আডবাণী। তাহলে আজ হঠাৎ কোথা থেকে আদর্শের কথা চলে এল?
ইতিহাসের আর একটি অদ্ভুত সমাপতন দেখুন। ১৯৭৮-এ সুরেশ রামের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার জন্য জগজীবন রামের শিবির জনতা দলেরই দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল। ওমপাল সিং আর কে সি ত্যাগী। কে এই ত্যাগী? আজ নিতীশ কুমারের দলের রাজ্যসভা সাংসদ। সেদিনের জনতা পার্টির যুবনেতা আজ জনতা দল ইউনাইটেডের হয়ে মীরা কুমারের বিরুদ্ধে এবং রামনাথ কোবিন্দের হয়ে ভোট দেওয়ার স্বপক্ষে সওয়াল করে চলেছেন।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন