কমলেন্দু সরকার :
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা ছবির নায়ক। উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলাদা একটা জায়গাও করে নিয়েছিলেন। তাঁর অগ্রজ এই দুই নায়কের মতো শুভেন্দুর গ্ল্যামার ছিল না। কিন্তু নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা খুব-কম ছিল না। মহিলা দর্শকেরা পছন্দ করতেন তাঁকে। অভিনয়েও কোনও অংশে কম ছিলেন না শুভেন্দু। অথচ নায়কসুলভ ব্যাপার তাঁর মধ্যে ছিল না। তবে বজায় রাখতেন তিনি বাংলা ছবির নামী নায়ক। তবে মানুষ শুভেন্দু কোনও দিনই নায়ক শুভেন্দুকে ছাপিয়ে যেতেন না। এমনই সুন্দর ছিল তাঁর ব্যবহার।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার ছিল বহুদিনের আলাপ। তাঁর কাছ থেকে বহু গল্পই শুনেছি। উত্তমকুমারের ওপর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। সেটা মালুম হত শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গেলে। তাঁর ঘরের চারিদিকে ছিল উত্তমকুমারের ছবি। বাংলা ছবির মহানায়কও খুব ভালবাসতেন তাঁকে। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির শুটিংয়ে উত্তমকুমারের হার্টের সমস্যা দেখা দিলে শুভেন্দুই প্রাথমিক শুশ্রূষা করেছিলেন। এবং তাঁরই পরামর্শে তৎক্ষণাৎ কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। মহানায়ক এ কথা পরবর্তী কালে স্বীকারও করেছিলেন।
উত্তমকুমার কতটা ভালবাসতেন শুভেন্দুকে একটা গল্প বললেই বোঝা যাবে। শুভেন্দুদার মুখেই শোনা যাক ঘটনাটা—- একদিন ভবানীপুরের এক পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নিচ্ছি। আমার ড্রাইভারই তেল ভরত। কিন্তু সে ঠিকমতো নিত না। একটু গড়বড় করত। তাই সেদিন আমি গাড়ি থেকে বেরিয়ে নজর রাখছি ড্রাইভারের ওপর। তা আমি তেলটেল ভরে স্টুডিয়ো গেছি। শুটিং ছিল। পাশের ফ্লোরেই শুটিং করছিল দাদা (উত্তমকুমার)। দু’জনের মেক-আপ রুমই পাশাপাশি। আমি মেক-আপ নেব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় এক প্রোডাকশন বয় এসে বলল, ‘দাদা ডাকছেন।’
আমি ভাবলাম কী হল আবার! ঢুকলাম দাদার ঘরে। মেক-আপ নিতে নিতেই দাদা বলল, ‘তুই ভবানীপুরের ওই পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়ে কী করছিলি রে!’
আমি বললাম, ওই তেল ভরছিলাম। ড্রাইভারটা মাঝে মাঝেই গণ্ডগোল করে। তাই দেখছিলাম ঠিকমতো তেল নেয় কিনা। তখন দাদা বলল, ‘তোর তেলের দাম কত?’
তখন তেলের দাম কম ছিল। আমি বললাম, এই এত। দাদা বলল, ‘তুই ওই ক’টা টাকার জন্যে ড্রাইভারের তেল নেওয়া দেখছিলি! তোর যে বক্স-অফিস চুরি হয়ে গেল সেটা খেয়াল করেছিলি। কত লোক তোকে রাস্তায় দেখল বলত।’ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে লাগলাম। দাদা বলল, ‘যা, আর কোনও দিন ওইরকম করিস না।’
আমি পরে ভাবলাম, সত্যিই তো। এটা তো ভাবিনি কোনও দিন। চারদিকে নজর ছিল তাঁর। এজন্যই উত্তমকুমার মহানায়ক। নিজেকে কোনও দিন মাটিতে নামিয়ে আনেননি। প্রোফেশনাল ক্ষেত্রে।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় একটা ভাল চরিত্র করার জন্য কত খাটতেন। হোমওয়র্ক করতেন। সেসব বলতেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’য় তাঁর ভূমিকা ছিল একজন দাঁতের ডাক্তারের। তিনি নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর দাঁতের ডাক্তারবন্ধুর কাছে গিয়ে বসে বসে লক্ষ করতেন একজন দাঁতের ডাক্তার কেমন বিহেভ করেন। বহুবার চিত্রনাট্য পড়তেন। পুরনো দিনের শিল্পীদের প্রতি ছিল বিনম্র শ্রদ্ধা। আর নতুনদের প্রতি অগাধ ভালবাসা। শুভেন্দুদা বলতেন, অনেকেই বলেন আজকালকার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করতে জানে না। এরা কী ভাল কাজের সুযোগ পেয়েছে! ক’জন ভাল পরিচালক পেয়েছে!
এই ছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’-এ প্রথম অভিনয়। তিনি নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু সত্যেন-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তারপর ‘কাচ কাটা হিরে’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘চৌরঙ্গি’ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘এখনই’-সহ বহু ছবি করেছিলেন। ছবির সংখ্যা ২০০-রও বেশি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অজয় কর, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-সহ নামীদামি অনেক পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছিলেন। সুখেন দাশের ছবি ‘রাজনন্দিনী’ (১৯৮০)-তে প্লেব্যাকও করেছিলেন। বেসিক গানের রেকর্ডও আছে। যার মধ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘একটি মোরগের কাহিনি’ও রয়েছে। বাংলা ছবির এই নায়ক মারা যান ২০০৫-এর এই দিনে অর্থাৎ ৫ জুলাই।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে চ্যানেল হিন্দুস্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন