পার্থসারথি পাণ্ডা
জন্মশতবর্ষের পথে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
পার্থসারথি পাণ্ডা
‘হ্যান্ড বুক অব মার্কসিজম’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়-কে মার্কসীয় রাজনীতির পথে টেনে এনেছিল, দিন বদলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সেই স্বপ্ন ভাষারূপ পেয়েছিল তাঁর কবিতায়। ১৯৪২-এ কবি পেয়েছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ। সক্রিয় রাজনীতির মধ্যে থেকেও তাঁর কবিতা নিছক পার্টি লিটারেচারে পরিণত হয়নি, হয়ে ওঠেছিল সংগ্রামী মানুষের জেগে ওঠার গান, জীবনসংগ্রামে পাশে থাকার আশ্বাস। চল্লিশের যুদ্ধ-দাঙ্গা-তেভাগা-মন্বন্তর সঙ্কুলিত রাজনৈতিক টালমাটালের যুগসন্ধিক্ষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
‘আমি আসছি—
দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আমি আসছি।
সঙীন উদ্যত করেছ কে? সরাও।
বাধার দেয়াল তুলেছ কে? সরাও।
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আমি আনছি
দূরন্ত দুর্নিবার শান্তি।’
জগৎজুড়ে যে পথে ‘শান্তি’ আনা সম্ভব, সেই পথেররেখা তাঁর কাছে ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁর কবিতায় সেই পথনির্দেশিকাও আছে। কবিতাটির নাম, ‘বাঁয়ে চলো, বাঁয়ে’—
‘বাঁয়ে চলো ভাই,
বাঁয়ে—
কালো রাত্রির বুক চিরে,
চলো
দুহাতে উপড়ে আনি
আমাদেরই লাল রক্তে রঙিন সকাল।’
যাঁরা দূর থেকে বহমান রাজনীতির স্পর্শ বাঁচিয়ে পথ খোঁজার নামে সংগ্রামের নামে রোম্যান্টিক বিলাসিতা করেন, এই কবি তাঁদের দলে পড়েন না। আটচল্লিশে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় সক্রিয় পার্টিসদস্য হিসেবে তিনি দু’বার জেলে গেছেন, অনশন ধর্মঘট করেছেন, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দীর্ঘ অভাব-অনটনে দিন কাটিয়েছেন, বজবজের বস্তিতে সংসার পেতেছেন, চটকলের মজুরদের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন, কলকাতা বন্দরে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ করেছেন। এই সংগ্রামের জীবন তিনি নিছক পার্টিসদস্য হিসেবে বেছে নেননি, মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই বারে বারে তাদের মাঝখানে গিয়ে তাঁদেরই একজন হতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কাছে দলের চেয়েও মানুষ বড়। কবিতায়, সংগ্রামে, সংগঠনে তাই তিনি শুধু জনজাগরণের পথ খুঁজেছেন।
১৯৬৪-তে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে গেল। বামফ্রন্ট সরকারে এলো। মাও এলেন, সন্ত্রাস হল, বলিদান হল, কিন্তু ‘শতপুস্প বিকশিত’ হল না। চোখের সামনে কবি দেখলেন, ‘নতুন যুগ’ বোবা কান্না কাঁদছে। ‘রাজা আসে, রাজা যায়’-পুরনো প্রবাদ সত্য হতে দেখলেন—
‘কেউ যায় না
শুধু জায়গা বদলে বদলে
সব কিছুই
জায়গা বদলে বদলে
সকলেই
থাকে।’ (‘কেউ যায় না’ কবিতা)।
‘জেল খানার গল্প’-কবিতায় আছে এই স্বপ্নভঙ্গে নিজের প্রতি নিজের শ্লেষ। উপলব্ধি করেছেন তাঁর মতো মানুষেরা আসলে—‘নিজেদের জালে বন্দী; নিজেদেরই তৈরি-করা জেলে।’ সে-এক এমন সময়, যখন ‘সবাই দেখে নিজেকে, কেউ তোমাকে দেখতে চায় না।’ অস্তিবাদের পথ ধরে সেই স্বপ্নভঙ্গের যুগেও ভেবেছেন তাঁর স্বপ্নপূরণের সাথি হতে নতুন সহযাত্রী কেউ-না-কেউ আসবেন।–
‘এ বাস আলো করে কেউ উঠবে।
হয়ত
খুব মজার কিছু ঘটবে।’
সময়ের এই দোলাচলতার মাঝে কখনও বা মন বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলে উঠেছে—
‘সামনের স্টপে আমি নেমে যাব।
… … …
…হাতের টিকিটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে,
আমি বলতে চাই না,
তবু আমাকে বলতেই হবে ‘বাঁচলাম’। (‘সামনের স্টপে’ কবিতা)।
১৯৮১-তে এসে শাসক বামফ্রন্টের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়তে বাড়তে পার্টির সদস্যপদ ছাড়লেন। পার্টি ছাড়লেন বটে, ‘নতুন যুগে’র স্বপ্ন ছাড়লেন না। নব্বইয়ে এসে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রতি তিনি আকৃষ্ট হলেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে, মানুষের মাঝে নেমে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ‘অগ্নিকন্যা’। এরকম সময়ে ‘ক্ষমতা গেল মমতায়/ মমতা গেল ক্ষমতায়’-এর মতো পঙক্তি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলম থেকে উঠে আসতে লাগল কবিতায়। গোঁড়া পন্থীবাদীদের কাছে বারে বারে কবি হতে লাগলেন বিরূপ সমালোচনায় বিক্ষত। সেই ক্ষত নিয়েও তখন তাঁর মনে হয়েছিল, একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই পারেন, তাঁর কাঙ্ক্ষিত জনজাগরণ ঘটাতে। মানুষের সাথে পথে নেমে মিছিল থেকে কবিতায় এসে কবি বুঝেছিলেন, চিরকাল দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ গন্ডির বাইরেই থেকে যায় সাধারণ মানুষের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর লড়াইয়ের পথ। আজ বেঁচে থাকলে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কবি হয়তো আরও অন্য কোনভাবে সেই পথের সন্ধান করতেন। পথের সন্ধানই একজন সৎ-কবির জীবনবৃত্ত, কারণ সেই পথ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘কবি চেনে, সম্পূর্ণ চেনে না।’
আজ ১২ ফেব্রুয়ারি, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিরানব্বইতম জন্মদিন। কবি পা রাখলেন জন্মশতবর্ষের পথে…
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan