Breaking News
Home / TRENDING / শিব গায়ে ছাই বা বিভূতি ধারণ করেছেন কেন? পড়ুন, শিব পুরাণের আশ্চর্য কাহিনি।

শিব গায়ে ছাই বা বিভূতি ধারণ করেছেন কেন? পড়ুন, শিব পুরাণের আশ্চর্য কাহিনি।

পার্থসারথি পাণ্ডা : 

ভৃগুবংশের এক ব্রাহ্মণ ছিলেন শিবের দারুণ ভক্ত। একদিন তাঁর মনে কি থেকে যে কি উদয় হল, ভাবতে বসলেন, জান্তে-অজান্তে কত পাপই তো হয়ে যায় জীবনে! কিন্তু পাপশরীরে তো আর শিবের চরণে ঠাঁই পাওয়া যাবে না! তাই শিবের এমন তপস্যা তিনি করবেন, যেমন তপস্যা কেউ কখনও করেননি। ! আর এই তপস্যার প্রভাবে সেই সমস্ত পাপ নষ্ট করে তিনি একেবারে পবিত্র হয়ে উঠবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ব্রাহ্মণ বসলেন তপস্যায়।

সে এক দেখার মতো তপস্যা, শেখার মতো সাধনা। প্রখর গ্রীষ্মে যখন সূর্যের দাবদাহে জগৎসংসার ত্রাহি ত্রাহি করছে, তখন ব্রাহ্মণ সূর্যকে মাথায় রেখে চারপাশে আগুন জ্বেলে দুরূহ তপস্যা শুরু করলেন। যে বর্ষার সূচের মতো তীক্ষ্ণধারায় মাটিতে গর্ত হয়ে যায়, সেই বর্ষার ধারা গায়ে সয়ে তিনি তপস্যা চালিয়ে যেতে লাগলেন। যে প্রবল শীতে জগৎপ্রপঞ্চে থরহরি কম্প, সেই প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে তিনি বরফশেতল জলের তলায় বসে তপস্যা করতে লাগলেন। সে এক দারুণ কৃচ্ছসাধনা, না দেখলে যেন বিশ্বাস হতে চায় না! এদিকে মানুষের শরীর যখন খিদেতেষ্টা তো পাবেই, তাও উপেক্ষা করলেন ব্রাহ্মণ; তপের আসন ছেড়ে কিছুতেই উঠলেন না। তাঁর সেই ত্যাগ দেখে মানব-দানব-স্বর্গের দেবতারা অবাক তো হলেনই, এমনকি বনের হিংস্র পশুরাও হিংসা ভুলে গেল। তারা হয়ে উঠল তাঁর পরম বন্ধু। তারা যে যেমন পারল বনের ফল মুখে করে এনে প্রতিদিন ব্রাহ্মণকে অর্ঘ্য দিতে শুরু করল। ব্রাহ্মণ তাই খেয়ে তাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে লাগলেন এবং তপস্যা চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কৃচ্ছসাধনা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল। এই সময় ফল খাওয়া ছেড়ে তিনি শুরু করলেন গাছের ঝরা পাতা খেতে। গাছের ঝরা পাতাকে বলে, ‘পর্ণপত্র’। তাই দেবতারা পর্ণভুক এই ব্রাহ্মণের নাম দিলেন, ‘পর্ণাদ’। এমনই কঠিন তিতিক্ষা আর তপস্যার মধ্য দিয়ে কত বছর যে পার হয়ে গেল, তার আর ইয়ত্তা রইল না।

তপস্যাস্থলের কাছে নিষ্ফলা জমি, সেখানে একদিন যজ্ঞের জন্য পর্ণাদ কুশ সংগ্রহ করছিলেন। মুহূর্তের অসাবধানতায় পর্ণাদের ডান হাতের মধ্যমা আঙুল কেটে গেল আর তা থেকে বেরুতে লাগল রক্তের বদলে শাকের রসের মতো এক সবুজাভ রস। তাই দেখে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন তিনি। এটাই তো তিনি চাইছিলেন! দীর্ঘ তপস্যার মধ্য দিয়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন, যেদিন তাঁর রক্ত শাকের রসের মতো হয়ে উঠবে, সেদিনই তিনি হয়ে উঠবেন নিষ্পাপ নিষ্কলুষ পবিত্র এক মানুষ। এতকাল পরে সেই দিন বুঝি আজ এলো! তাঁর মতো পবিত্র মানুষ আর কে আছে আজ এই পৃথিবীতে! আনন্দের চোটে মনে তাঁর অহং এলো, সেই অহং-এ তিনি নাচতে শুরু করলেন পাগলের মতো আর থেকে থেকে ছাড়তে লাগলেন বীভৎস হুংকার। সময় বয়ে যায়, তবু তাঁর সেই পাগলপারা নাচ আর কিছুতেই থামে না!

ইতিমধ্যে বন্ধু পশুরা পর্ণাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁর এই পাগলপারা হাল দেখে প্রথমে হতভম্ব হল, তারপর তাঁর ভয়ানক গর্জন শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল তারা। নিজেকে নিয়ে বিভোর পর্ণাদ তাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। অহংমত্ত পর্ণাদ বুঝতেও পারলেন না যে, তিনি কোন সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছেন। অহংই তো পাপ বয়ে আনে জীবের দেহেমনে, করে দেয় তার সমস্ত কলুষ!

পরমভক্তকে এই পতনের পথে নামতে দেখে স্থির থাকতে পারলেন না শিব। তিনি নেমে এলেন মর্ত্যে ব্রাহ্মণের বেশে। দূর থেকেই পর্ণাদের নাম ধরে হাঁকডাক করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কথা মত্ত পর্ণাদ শুনতেই পেলেন না। তিনি কাছে আসতেই নাচতে নাচতে পর্ণাদের চোখ পড়ল হঠাৎ তাঁর চোখে। সেই চোখের দিকে চেয়ে পর্ণাদ কেমন যেন হয়ে গেলেন, তিনি থেমে স্থির হয়ে গেলেন। তখন স্মিত হেসে ব্রাহ্মণরূপী শিব তাঁকে বললেন, ‘ওহে পর্ণাদ, এ তুমি কি করছ! এই চরাচরে তুমি তো একা নও, তোমার চেয়েও সহস্রগুণ সিদ্ধ ভক্ত রয়েছেন; তবুও তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে বসলে! ভুলে গেলে অহংকারই পতনের মূল! তোমার রক্ত তো সবে শাকের রসের রূপ নিয়েছে, আমার রক্ত কেমন জানো?’ বলতে বলতে শিব কড়ে আঙুলের নখ দিয়ে ডান হাতের মধ্যমা চিরে ফেললেন এবং কী আশ্চর্য, তা থেকে ঝরে পড়তে লাগল অঝোর ধারায় সাদা ছাই, বিভূতি! পর্ণাদ অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন সেই বিভূতিধারা। দেখলেন, সেই ব্রাহ্মণের সারা গায়ে ফুটে উঠছে বিভূতিচিহ্ন। তাই দেখে হঠাতই তাঁর যেন বোধদয় হল, অহং-এর পর্দা সরে খুলে গেল জ্ঞানের চোখ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে পায়ে পড়লেন সেই ব্রাহ্মণের। বললেন, ‘আপনি সামান্য ব্রাহ্মণ নন, আমায় কৃপা করুন! হে প্রভু, আমার অন্তর বলছে, আপনি ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু মহাদেব। প্রভু, স্বরূপে দর্শন দিয়ে আমায় কৃপা করুন, আমায় পথ দেখিয়ে ধন্য করুন!’

পর্ণাদের আকুলতায় শিব তুষ্ট হলেন। দর্শন দিলেন শিবস্বরূপে। তারপর পর্ণাদকে বুঝিয়ে দিলেন বিভূতি মাহাত্ম্য। বললেন যে, এই বিভূতি যে ভক্ত শরীরে ধারণ করেন, বিভূতিতে অবগাহন করেন; তিনি সমস্ত তীর্থ ও পুণ্যসলিলে অবগাহন করার পুণ্য অর্জন করে হয়ে ওঠেন কলুষহীন পবিত্র। তিনি ঠাঁই পান তাঁর পরম চরণে।

শিব কথিত এই ‘অবগাহন’-এর অন্য একটি মানে আছে। সেটা এবার বলি।

আসলে এই যে বিভূতি, এ তো সাধারণ ছাই নয়, এ হল শরীরের সমস্ত পাপের মূল অহংপোড়া ছাই। হিন্দু শাস্ত্রে অপার্থিব শরীর পোড়ানো বা দাহের এক নাম, ‘সৎকার’। দাহকর্মের নাম, ‘সৎকাজ’। তাই শিবপ্রিয় হয়ে উঠতে গেলে অহংকে মৃতদেহের মতোই দাহ করার সাধনা করতে হবে। অবগাহনে শরীর যেমন নির্মল হয়ে ওঠে, তেমনি একবার অহং দাহ করতে পারলে তাতে আত্মা অবগাহন করে আত্মা নির্মল ও পবিত্র হয়ে ওঠে। তখন আর কোন তীর্থ করার প্রয়োজন পড়ে না, তখন সেই আত্মার আধার এ দেহই হয়ে ওঠে নিষ্কাম এক তীর্থ। যুগে যুগে ভক্তদের এ কথা মনে করিয়ে দিতেই শিব সেই পর্ণাদের কাল থেকে অঙ্গে ধারণ করে রয়েছেন বিভূতি বা ছাই। আর পরমশিব ভক্তরাও আরাধ্য শিবের এই শিক্ষা স্মরণে রাখতে নিজেদের শরীরে লেপন করে থাকেন শিবের নামে বিভূতি অর্থাৎ পার্থিব ছাই।

Spread the love

Check Also

চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক

ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …

আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ

জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *