কিশোর ঘোষ:
বাংলা ভাষায় হাতে গোণা গ্র্যান্ড কবি, তাঁদের একজন শক্তি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
আসলে প্রত্যেক ভাষায় মাঝেসাঝে এমন একেকজন আসেন, যাঁরা আসেন বলে সেই ভাষার আয়ু আরও পঞ্চাশ কী একশো বছর বেড়ে যায়। কেন বাড়ে? কারণ তাঁর লেখার শক্তিতে, সামর্থে সেই ভাষার কাছে আসতে বাধ্য হয় হাজার হাজার, কখনও বা লাখ লাখ একই ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকা। এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কান্ড। মহাকবির কাব্যবোধের চুম্বকশক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে আসেন পরবর্তী তরুণরাও। আজ আর বুঝতে বাকি নেই যে মাইকেল হয়ে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ হয়ে জীবনানন্দের পর সেই গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড কবির নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
ব্যাপারটা বোঝানো গেল কী? গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান দেখেছেন? ছবিতে দেখলেও চলবে। তাজমহল দেখেছেন নিশ্চয়ই, সামনে থেকে। কিংবা বিপুলা পদ্মা, তার মাথায় ঘণঘোর আষাঢ়ের মেঘ, এভাবে ভাবুন। অথবা ধরুন এমন সময় শঙ্করপুরে পৌঁছেছেন, হয়তো মধ্যরাত্রি, হোটেল পাননি। আপনি ছাড়া বিচে কেউ নেই। আর সমুদ্র, আর সমুদ্র, আর সমুদ্র…!
শেষ দৃশ্যে আপনি হলেন বাংলা কবিতার পাঠক বা পাঠিকা, আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় হলেন ওই সমুদ্র। মুহুর্মুহু ভাবনার ঢেউ এসে ভাঙছে বালির পাড়, জ্বলে উঠছে সাধনার ফসফরাস, উত্তাল শব্দের কোরাস, আর হাওয়ার প্রবল আবেগ। এর মধ্যে যদি বর্ষা এসে গেল তবে তো মেধা ফালাফালা হয়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গ, বুক এফোঁড়-ওফোঁড়, ঝাউবনের ভেতর দিয়ে আপনি দৌড়চ্ছেন—জন্ম তাড়া করলে মৃত্যুর দিকে, মৃত্যু তাড়া করলে জন্মের দিকে…! অর্থাৎ কিনা বিপজ্জনকভাবে নিমজ্জিত আপনি শক্তি সমুদ্র চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে পড়তে…।
আমি বিশ্বাস করি, শক্তি যাঁরা পড়েছেন তাঁদের কাছে ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’র এই ডিসকোর্স স্পষ্ট। কীভাবে কেউ কখনও বলে উঠতে পারে, আমি ‘সোনার মাছি খুন করেছি’—প্রবল ভাবে জানেন ‘শক্তি-শালী’ পাঠক। এও আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে শক্তিকে পাঠ করতে হলে শক্তিশালি পাঠক হয়ে উঠতে হয়। কারণ তিনি ভালো কবি নন, এমনকী খুব ভালোদের মধ্যেও পড়েন না ‘হেমন্তের অরণ্যে’-এর ‘পোস্টম্যান’। যেহেতু শক্তি চট্টোপাধ্যায় মানে খাঁটি কবি’। মহা প্রতিভা বোঝেন নিশ্চয়ই। এবার একটা আশ্চর্য বলব, তা এই যে একজন গ্র্যান্ড পোয়েট হয়েও, মেজর আর্ট ওয়ার্ক করেও ‘পপুলার আর্ট’-এর ম্যাজিক উদাহরণ রেখে গেলেন শক্তি।
‘অবনি বাড়ি আছো’র মতো ভুরি ভুরি। ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’র মতো অসংখ্য! যা দেখেশুনে বলতেই হয়, কবিতা জগতে এমন বেনজিরের কারিগরও তিনিই। এই যেমন, মোটামুটি যাঁরা কবিতা পড়েন তাঁদেরকে ‘কান ধরে’ কবিতা পড়ালেন, পড়িয়ে চলেছেন আজও। জলজ্যান্ত প্রমাণ কবির বইয়ের বিক্রি। জীবিত অবস্থায় তো বটেই, এমনকী আজও বহু ‘জ্যান্ত’ কিংবা ‘মরা’ কবিদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। যদিও ‘আর্ট’ ও ‘পপুলার’ শব্দ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষত কবিতার দুনিয়ায় এই দুই শব্দের সম্পর্ক তো অমিতাভ-রাজেশ খান্নাদের হিন্দি ছবির হিরো আর ভিলেনের মতো। সাধারণ ধারণা—‘পপুলার’, যেমন মালাইকা আরোরা। যাঁর সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক তাঁর গায়ে জড়ানো ডিজাইন কাপড়ের মতো, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়। অন্যদিকে ‘আর্ট’, যেমন ‘স্টারি নাইট’, যা পপুলার হতে হতে শিল্পীকে বেঘোরে মরতে হয়েছে, মরে ভূত হতে হয়েছে, সেই ভূত ফের জন্ম নিয়েছে, তারপর তা পপুলার হয়েছে!
কিন্তু সবক্ষেত্রের মতো এখানেও আছে ব্যতিক্রম। দুম করে মনে পড়ছে, শিল্পের ইতিহাসের তিন মহানের কথা, যাঁরা বাস্তবিক ‘পপুলার আর্ট’-এর আশ্চর্য নজির সৃষ্টি করে গিয়েছেন নিজের সময়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথ, পাবলো পিকাসো, চার্লি চ্যাপলিন। এইখানে বলে রাখা ভালো, ‘পপুলার আর্ট’ বন্ধনীতে রবীন্দ্রনাথ থাকলেও কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে গোটা জীবনেই কিন্তু ‘পপুলারিটি’র শিকে সমানভাবে ছেঁড়েনি। ‘বিফোর নোবেল’, ‘আফটার নোবেল’ ফ্যাক্টর এখানে বিবেচ্য।
তবু, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেঁচে থাকাকালীন কবিখ্যাতি চেখে গেছেন। (সেই খ্যাতির মধ্যে যে চোনাও ছিল, তা এখন আলোচ্য নয়)। কথা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের হাতে গোণা যে চার গ্র্যান্ড কবি, মানে মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-শক্তি, এদেরকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সেই দু’ভাগের একদিকে থাকবেন মাইকেল-জীবনানন্দ, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ-শক্তি। যেহেতু জীবিতকালে মাইকেল ও জীবনানন্দের ততখানি কবিখ্যাতি ছিল না, মৃত্যুর পর যতখানি উন্মাদনা দেখা গেল। তবে একটা বিষয় বলে দিলেও চলে যে, কোনও গ্র্যান্ড কবিই সভ্যতার হাজার উস্কানি পেলেও ‘বিজ্ঞাপন’ লেখেননি বা লিখবেন না। নিজের সহজাত প্রতিভাতেই থাকেবন। তাতে যা হবে, হবে। সেই প্রক্রিয়ায় থেকেই জীবনানন্দের এক হল, শক্তির আরেক। কেন এমনটা?
তার কারণ কী জীবনানন্দের বন্ধুহীনতা, একগুঁয়েমি? তার কারণ কি শক্তির অন্তর দুর্ভেদ্য হলেও বাইরে সাহিত্য-বন্ধুদের সঙ্গে প্রবল মেলামেশা? শুধু এটুকুই নয়। আরও কারণ রয়েছে। সেই বিস্তারিত বিশ্লেষণের সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু এটুকু না বললেই নয় যে যাঁরা শক্তির ট্র্যাস কবিতা নিয়ে সমালোচনা করেন, তারা ওই ট্রাসটুকুও হয়তো লিখে উঠতে পারেননি গোটা জীবনে। এই যেমন—
শব্দের নিজস্ব অনুতাপ তাকে পুড়িয়েছে জ্বরে
সে শুয়ে রয়েছে তার চতুর্দিকে কমলার খোসা
যেন সে নক্ষত্রহারা তরুণের মতো লাল চুপ
কাঁধের উপরে ফেলে, উদাসীন, পড়েই রয়েছে…
(উদাসীন, পড়েই রয়েছে/ যুগলবন্দী
তবু, অতিরিক্ত জনপ্রিয়তা কিছু ক্ষতি তো করেই। তারপরেও একজন কবির এতগুলি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ! এত এত মহান কবিতা! অসংখ্য স্মরণীয় পংক্তি—”আমার ভাবনা হলো বিশাল বাগান কেমন করে মনে রাখবে/ প্রতিটি গাছে পাখিরা আসছে, প্রতিটি দুঃখ…”। সকলের মনে পড়ে ‘রাতের কল্লোল’, ‘স্বেচ্ছাচার’, চোখে দেখতে ইচ্ছে করে সেই আশ্চর্য ‘পিড়িটি’, ভালোবাসাকে যাতে বসতে আহ্বান জানান কবি। আর ‘আনন্দ ভৈরবী’, আর দুরন্ত ছেলে, দস্যু-প্রেমিক! প্রেমিকাকে না পেলে যে বেড়ালের কপালেও সিঁদুর পরাতে পারে। হায়, ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’, অথবা ‘আমার মতো একলা মানুষ দু’খান হয়ে শুই’ বলেন তিনিই। কিংবা ‘আসলে, কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মত দেখায় ‘। বলে শেষ করা যাবে না! কিন্তু এই যে বটগাছের শিকড়ের মতো ভাবনার তরঙ্গ বিস্তার, ক্ষেপামো… এই হল মহা কবির উন্মাদ-প্রতিভার সাক্ষ্য। যা মনে রাখতে বাধ্য হয় কবিতাপ্রিয় বাঙালি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তবে গ্র্যান্ড কবি তো, ফলে চোরাবালিও আছে। যেমন, ছোটবেলায় চার্লি চ্যাপলিন দেখলে এক মনে হয়, বড় হয়ে আরেক! তাই বলে ছোটবেলার দেখাটাও মিথ্যে না। কিন্তু, তবু, বহুমাত্রার বাদাম ভাঙলে আরও আরও স্বাদের খনি। ওই জন্যই বলছিলাম, শক্তির পাঠককে হতেই হবে শক্তি-শালী।
এই কারণেই বাংলা ভাষার হাতে গোণা গ্র্যান্ড কবিদের একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
……………………
কিশোর ঘোষ শূন্য দশকের অন্যতম কবি। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি। ‘উট-পালকের ডায়েরি’ (২০০৯, হাওয়াকল), ‘সাবমেরিন’ (২০১৫, হাওয়াকল), ‘সফট পোর্ট্রেট’ (২০১৯, কারিগর)। গদ্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নাদেশ থেকে স্বপ্নদোষ অবধি’ (২০১৮, ইতিকথা)। ‘উট-পালকের ডায়েরি’র জন্য পেয়েছেন ‘দৌড় সম্মান’। তাঁর একাধিক কবিতা ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবিতা ছাড়াও গল্প ও গদ্য লিখিয়ে হিসেবেও পরিচিত। একাধিক থিয়েটার ও সিনেমার জন্য গান লিখেছেন।