কমলেন্দু সরকার :
খুবই অনাড়ম্বরে চলে রাজেন তরফদারের শতবর্ষ। উনি বিশ্ববরেণ্য দুই বাঙালি পরিচালক প্রয়াত সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের বয়সে বড় ছিলেন। ছবি করার শুরু তাঁদের সময়েই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি।
১৯৪০-এ গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে চাকরি নিয়েছিলেন নামী সাহেবি বিজ্ঞাপন কোম্পানি জে ওয়াল্টার থমসন-এ। সেই কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। তবে ছবি করার ভাবনা মাথায় আসতেই কোনও দ্বিধা না-রেখেই মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
পুরো সময়ের পরিচালক হলেন। তবে ৩০ বছরের পরিচালকজীবনে মাত্র সাতটি ছবি করেছিলেন! ওই সাতট ছবিতেই রাজেন তরফদার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কী জাতের পরিচালক! ১৯৫১-য় জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ই তাঁকেও আকৃষ্ট করেছিল। সেইথেকেই ছবি তৈরির ভাবনা। ইতালির নয়া বাস্তবতা রাজেনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
তাঁর প্রথম ছবি ‘অন্তরীক্ষ’। কাহিনি তুলসি লাহিড়ি। সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। পরের ছবি সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ নিয়ে একই নামে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গঙ্গা’ (১৯৬০) ছিল প্রতিযোগিতা বিভাগে। এই ছবি বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে। সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’কে তিনি দেখেছিলেন এক দার্শনিক কোণ থেকে। সেই কারণে সমরেশ বসুর উপন্যসের সঙ্গে রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’কে হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনি নিয়ে করলেন ‘অগ্নিশিখা’ (১৯৬২)। এই ছবি একজন সৎ শিল্পী হিসেবে রাজেন তরফদারকে বাংলা ছবিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এরপর শক্তিপদ রাজগুরু গল্প নিয়ে ‘জীবনকাহিনি’ (১৯৬৪)। এ ছবি শুরু করার আগে তিনি অনুপকুমারকে বলতেন, ‘চলেন মশাই এবার নেইগে পড়ি।’ অনুপও বলতেন, ‘আমি তো ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বইসে রয়েছি, চলেন যাই।’
‘আকাশছোঁয়া’র (১৯৬৭) মূল কেন্দ্রে ছিল সার্কাস। নায়ক হলেন মোটরবাইক স্টান্ট খেলোয়াড়। করেছিলেন দিলীপ মুখোপাধ্যায়। তিনিই এ ছবির প্রযোজক। অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক জাগলারের ভূমিকায়। অনিল চট্টোপাধ্যায় শিখেও গিয়েছিলেন জাগলিং। যেমন কামু মুখোপাধ্যায় শিখেছিলেন সন্দীপ রায়ের ছবি ‘ফটিকচাঁদ’ করার সময়। যাই হোক, রাজেন তরফদারের ‘আকাশছোঁয়া’র খরচ কমাতে রাত জেগে শুটিং করতেন। কেননা, সন্ধেবেলার শো শেষ করে পানামা সার্কাস দল চলে আসত স্টুডিয়োপাড়ায়।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে করলেন ‘পালঙ্ক’ (১৯৭৫)। দেশভাগ, পুব বাংলা, এবং বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে উদ্বাস্তুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং একটি পালঙ্ক ঘিরে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ। এবং সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ঊর্ধে আসে বাঙালি মূল্যবোধ। অসাধারণ ছবি ‘পালঙ্ক’।
শেষ ছবি ‘নাগপাশ’ (১৯৮৭)। এই ছবির শুটিং হয়েছিল সুন্দরবনের গোসাবায়। তিনি এক কোমর জলে নেমে শট নিতেন। নদীতে কুমিরের তোয়াক্কা করতেন না। ‘নাগপাশ’-এ হাত দেওয়ার আগে তিনি ভেবেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি। তা আর হয়ে ওঠেনি অন্যজনের কাছে উপন্যাসটি চিত্রস্বত্ব থাকার জন্য। তখনই সাধন চট্টোপাধ্যায়ের সমকালের রাজনীতি নিয়ে লেখা ‘নাগপাশ’।
তিনি চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন ‘গণদেবতা’, তরুণ মজুমদারের সঙ্গে ‘সংসার সীমান্তে’র। অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ এবং ‘খন্ডহর’-এ। শেখর চট্টোপাধ্যায়ের ‘বসুন্ধরা’য় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অভিনেতা হিসেবে কম জান না! আর এক বরেণ্য পরিচালক শ্যাম বেনগল বলতেন, ‘রাজেন তরফদার হলেন জিনিয়াস পরিচালক। এই ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন রাজেন তরফদার।
অনেকেই বলেন রাজেন তরফদার ছিলেন খরচসাপেক্ষ পরিচালক! মূলত রাজেন তরফদার ছিলেন একজন শিল্পী। তারপর চলচ্চিত্র পরিচালক। সেই কারণে, যখন তিনি ছবি করতেন, তখন বিভিন্ন কোণ থেকে ছবিটাকে দেখতে পেতেন। তাই হয়তো কিছু বেশি এক্সপোজ হয়ে যেত। সৎ ছবির প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও জীবিতকালে তিনি সেই মর্যাদা এবং স্বীকৃতি পাননি। এখন তো ভুলতে যেতে বসেছে নতুন প্রজন্ম রাজেন তরফদারকে!
পরিচালকের শতবর্ষে চ্যানেল হিন্দুস্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন