দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়
ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদে কলকাতায় ভাঙা হল শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যারা লেনিনের মূর্তি ভেঙেছে তারা এরপর গান্ধি, সুভাষ বসু, আম্বেদকর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মূর্তি ভাঙবে! একই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, এই রাজ্যে বামেরা কোথাও যাতে আক্রান্ত না হয়, সেদিকেও নজর রাখবে তাঁর সরকার।
‘যারা লেনিনের মূর্তি ভেঙেছে’ বলে মুখ্যমন্ত্রী যদি বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারকে ইঙ্গিত করেন, তাহলে সঙ্ঘের তরফে তাঁর জন্য বার্তা এই যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো ভারতীয় মনীষীরা আরএসএসের প্রাতঃস্মরণীয়দের তালিকায় আছেন। ফলে, তাঁদের পক্ষে আর যাই হোক ভারতের এইসব মনীষীদের মূর্তি ভাঙা সম্ভব নয়।
মুখ্যমন্ত্রী মনীষীদের নাম বলার সময় শ্যামাপ্রসাদের নাম বলেন নি। এ দেশে গান্ধি-নেহরুর চোখে চোখ রেখে যাঁরাই কথা বলেছেন, যে কোনও কারণেই হোক, তাঁদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। সে শ্যামাপ্রসাদই হোন বা সুভাষ বোস বা দীনদয়াল উপাধ্যায়। এমনকি মিষ্টভাষী, শিষ্ট ব্যক্তিত্বের লালবাহাদুরও মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন রাশিয়া থেকে দেশে ফিরে গিয়ে এমন খবর দেবেন যাতে গোটা দেশ উদ্বেলিত হয়ে যাবে! জীবিত অবস্থায় আর তাঁর দেশ ফেরা হয় নি!
এ দেশের বামেরাও শ্যামাপ্রসাদকে সাম্প্রদায়িক, নেতাজীকে তোজোর কুকুর বানিয়ে ছেড়েছেন। যাঁর জন্য পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্য ভারত ভূখণ্ডে আছে, আর আজ যার মসনদে মমতা বসে আছেন, তিনি বলার সময় শ্যামাপ্রসাদের নাম বলেন নি। কারণ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, মূর্তি ভাঙলে ভাঙবে আরএসএস -বিজেপি। অধুনা তাঁর অনুপ্রেরণায় আন্দোলনমুখী হওয়া বামেরা ও অতি সম্প্রতি তাঁর কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া বামেরা যে এমন একটি কাজ করতে পারে তা হয়তো তিনি ভাবতেই পারেন নি!
যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর পাড়াতেই সকাল সকাল কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। শ্যামাপ্রসাদের মুখে কালি লাগিয়ে ও চোখ কান ভেঙে লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রতিশোধ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের আবেগ বোঝা যায়। প্রিয় নেতার, আদর্শ ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তির অপমানে কয়েকজন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর অনিয়ন্ত্রিত আবেগ বোঝা যায়। যা বোঝা যায় না, তা হল ত্রিপুরার শোধ বঙ্গে তোলা কেন এতটাই সহজ! পাঁচটি ছেলে মেয়ে সকালবেলা কেওড়াতলার মতো একটি সদা ব্যস্ত জায়গায় দেশের একজন চিন্তানায়কের মূর্তিতে কালি মাখাবে, মূর্তির ক্ষতি করবে… কি করে সম্ভব হয়! সম্ভব সম্ভবত হয় তখনই যখন আগে থেকেই বুঝে নেওয়া যায় কার মূর্তি ভাঙলে কোন রাজ্যে কতটা ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে! ‘বিপ্লবী পঞ্চপাণ্ডবকে’ পুলিশ আপাতত গ্রেফতার করেছে ঠিকই তবু শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে মমতার প্রশাসন কী করে সে দিকে নজর রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে লেনিনের মূর্তি ভাঙা নিয়ে প্রতিবাদ করার কোনও নৈতিক অধিকার মমতার আছে কী না! মুকুল রায় মনে করিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে যাদবপুরে তৃণমূলের হাতে লেনিনের মূর্তি ভাঙা পড়ার কথা। তারও আগে খেজুরিতে একই ঘটনা ঘটিয়ে ছিল তৃণমূল। এই রাজ্যেই স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি পদদলিত হয়েছে যাদবপুরে। নেতাজির মূর্তিতে কালিলেপন হয়েছে কয়েক মাস আগে। এই সব ঘটনাতেই দায়ী হয় তৃণমূল নয় বাম। নকশাল আমলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা যদি চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অঙ্গ হয়, তাহলে ধ’রে নিতে আটকাচ্ছে কোথায় যে লেনিনের মূর্তি ভেঙে ভারতেও নয়া সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হল?
তবে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে পাইকারি হারে ভাঙচুর, শিক্ষকদের অসম্মান, পরবর্তী সময়ের জন্য কোনও মধুর স্মৃতি রেখে যায় নি। মূর্তি ভাঙার জন্য যেমন ক্ষণিকের আবেগ কাজ করে তেমনই পেশীরও কাজ কম থাকে না। আবার মূর্তি ভাঙার পিছনে কখনও কখনও রাজনৈতিক দর্শনও থাকে। আবার আধ্যাত্মিক দর্শনও থাকে। মাও-এর রেড ফোর্স যেমন একটি দর্শনের তাড়নায় বা তালিবানরা উগ্র ধর্মীয় ভাবাবেগের তাড়নায় মূর্তি ভাঙার উৎসবে মেতেছিল, সেই উৎসব আবার না ফিরলেই ভাল। মূর্তি ভাঙা তো উপলক্ষ্য মাত্র যদি লক্ষ্য হয় ভাবমূর্তি ভাঙা তাহলে পেশীর চর্চা একদিকে সরিয়ে রেখে, মেধা, যুক্তি, তর্কের চর্চাই ভাল।
নাস্তিকতার উপরে আস্তিকতাকে কেউ প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেই পারেন কিংবা তার উল্টোটা। একই ভাবে গান্ধিজির ওপর নেতাজিকে, মার্কসের সাম্যবাদের ওপর বৈদিক সাম্যবাদকে, ইহার উপর উহাকে, উহার উপর ইহাকে কেউ প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেই পারেন। তবে সেটা জ্ঞানের চর্চা দিয়ে হওয়াই ভাল।
ভারতবর্ষে আদিকাল থেকে এই জ্ঞানের চর্চাই হয়ে আসছে। এ দেশে এটাই মানায়।
মূর্তি ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমে বাতাসে ধুলো না বাড়িয়ে, ভাবমূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হোক! লেখায়, কথায় উঠে আসুক আইকনক্ল্যাস্টরা। ভণ্ডামোর অবসান হোক।
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan