মধুমন্তী
একটি পত্রিকার পুজোসংখ্যা প্রচ্ছদের ছবি নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি নারী মূর্তি। যাঁর ঊর্ধ্বাংশ এক টুকরো কাপড়ে আবৃত। যা মূলত এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে গত কয়েকদিনে। যদিও এমন বিতর্ক নতুন নয়। একটা সময় শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা সরস্বতী ছবি নিয়েও তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। কেউ ছবিটি নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছিলেন তো কেউ ছবিটিকে স্রেফ শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন।
আজ এই ছবি-বিতর্ককে কেন্দ্র করে ওই দৈনিকের অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচী নিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দল। অন্যদিকে সেই ঘটনাকেই নিন্দার নজরে দেখলেন কলকাতার লেখক এবং শিল্পীদের একাংশ।
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, “হিন্দু ধর্মের মর্ম থেকে উঠে আসা একটি ছবি এটি। এটার মধ্যে কোনও অশ্লীলতা তো নেই বরং আমরা যদি আদিভাস্কর্য দেখি, ভুবনেশ্বরের মন্দির দেখি, তাহলে বুঝব আমাদের সংস্কৃতি কী! এই আন্দোলনের কোনও মানেই হয় না।”
মূলত একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে বলে মত শিল্পী সমীর আইচের। তিনি জানান, “যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করছেন তাঁদের শ্লীলতা-অশ্লীলতা বোধ নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে কতটা জানেন আমি জানি না, জানলে হয়তো এমন বক্তব্য রাখতেন না। তাঁরা যদি ভারতীয় সংস্কৃতির চিত্রকলার ইতিহাস দেখেন, পুরাণের ছবিগুলো যদি দেখেন তখন এই ছবিটির মধ্যে কোনও অশ্লীলতা পাবেন না। এটা পুরোটাই একটা রাজনৈতিক মোটিভেশন। যেভাবে ঘেরাও ওঁরা করছেন তাতে ওঁরা সফল হবেন বলে মনে হয় না। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শুধু তাই নয় গোটা ভারতবব্যাপী তাঁরা শিল্পীর ভাবনায় গণ্ডি টানতে চাইছেন। সবমিলিয়ে একটি হাস্যকর আন্দোলন। এটা সমাজকে খারাপ বার্তাই দেবে।”
“ছবিতে শ্লীলতা-অশ্লীলতার অনেক আগে আমাদের মাথায় রাখতে হবে এটা একটা ছবি”, এমনই মত শিল্পী সুব্রত চৌধুরীর। এমনকী তিনি জানান, “অজন্তার গুহাচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পী হয়তো এই ছবি এঁকেছেন। সেখানে একেবারেই অনাবৃত রয়েছে ছবি। এরসঙ্গে শিল্পীর একটি স্বাধীন সত্তাও আছে। দেবী শুধু বিদ্যার নয়, কামকলারও দেবী, সেই ভাবনা থেকেই হুসেনও সরস্বতীর ছবিটি এঁকেছিলেন। তখনও আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু আজকের দিনে শিল্পীর একটা নিজস্ব সত্তা থাকা উচিত।”
কলকাতার অন্যতম শিল্পী সনাতন দিন্দা। কলকাতার দুর্গা পুজোয় একাধিক থিমের ভাবনায় যাঁর অবিরাম যাতায়াত। ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করে তিনি জানান, “অজন্তার ‘ব্ল্যাক প্রিন্সেস’ ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি। এটা সম্পূর্ণ একজন শিল্পীর ব্যক্তি স্বাধীনতা। দেবীকে সুন্দরী করে তোলার একটা প্রবণতা চিরকাল ছিল। কিন্তু অজন্তা, ইলোরা, কোনার্ক, খাজুরহো, সূর্যমন্দির এগুলো দেখলে বোঝা যাবে ভারতের সংস্কৃতি ঠিক কী! এটাই ভারতের রীতিনীতি। আমি এই ছবির মধ্যে কোনও অশ্লীলতা খুঁজে পাচ্ছি না। একটা ইস্যু খুঁজতে হবে তাই এরকম ঘেরাও, প্রতিবাদ। এর কোনও মানে নেই।”
“এই ধরনের ঘটনাকে কোনওদিনই বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। যে-কোনও সৃজনশীল মানুষের একটা অধিকার আছে তাঁর মতো করে স্বাধীনভাবে কিছু সৃষ্টি করার। হিন্দু সভ্যতা বা প্রাচীন সভ্যতা যদি দেখি তাহলে অনেক আগে থেকেই এইরকম ছবি ভারতীয় সংস্কৃতিতে আছে। একটা আধুনিকতার ছাপ ছিলই। সেসময় তথাকথিত ছুঁতমার্গ তো কিছুই ছিল না। আর দেবতার কথাও যদি দেখি, তবে তিনি অত অস্পৃশ্য নন যে, তাঁর গায়ের জামা কী হবে তার ভিত্তিতে আমাদের ধর্মবিশ্বাস ছোট হয়ে যাবে। এগুলো একপ্রকারের রাজনীতি।”, এমনই মত শিল্পী শুভাপ্রসন্নর।
সব মিলিয়ে একটা ছবিকে কেন্দ্র করে এমন আন্দোলনের কোনও যৌক্তিকতাই দেখছেন না শিল্পীমহল। বরং আরও অনেক বেশি স্বাধীনচেতা করতে হবে মানুষের চিন্তাকে, বলছেন শিল্পীরা।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন