সঞ্জয় বাৎস্যায়ন :
২০১৯ -এ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।
অমিত শাহ সহ কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব এখন ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীর জন্য নিরাপদ আসনের খোঁজে। প্রাথমিক ভাবে গোটা পাঁচেক আসনও চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। প্রতিটি আসনের ক্ষেত্রে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিও আছে।যেমন,উত্তরবঙ্গের কোচবিহার। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার থেকে উত্তরের সমতলে খাতা খোলার ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত রাজ্য বিজেপি। গত কয়েক বছরে কোচ-রাজবংশী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয়তা বেড়েছে আরএসএস ও বিজেপির।সাংগঠনিক শক্তির বিচারে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার এখন বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরবঙ্গের জনতার বঞ্চনাবোধ। সব মিলিয়ে উত্তরের সংগঠনের ফুটন্ত রক্ত উথলে দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী হওয়ার মত ভালো অনুঘটক পাওয়া কঠিন বলেই মত রাজ্য বিজেপির একাংশের। উল্টো মতও আছে। আসন সংখ্যার বিচারে উত্তরের গুরুত্ব কম। রাজনীতির ময়দানে সর্বভারতীয় পরিসরে সেই গ্ল্যামারও নেই। তার ওপরে উত্তরের জমি ইতিমধ্যেই পোক্ত। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘ব্যবহার’ করাটা শক্তির অপচয় বলেই মত আরেক অংশের। ২০১১ পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু নির্ভর রাজনীতির সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আরএসএস-বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা। বিশেষত দক্ষিণবঙ্গের দুই সীমান্তবর্তী জেলা নদীয়া ও উত্তর 24 পরগনায়।কৃষ্ণনগর সে কারণেই ‘ভালো আসন’ বলে মনে করছেন রাজ্য বিজেপির কট্টরপন্থীরা। এর আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় এই আসন থেকে জিতেই কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। বিখ্যাত আইনজীবী ‘জুলু’বাবু তাঁর সামাজিক কাজের জন্য এখনও বিপুল জনপ্রিয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রার্থী হলে অশীতিপর ‘জুলু’বাবু সেটা নিজের নির্বাচন মনে করেই জান লড়িয়ে দেবেন,এমনটাই মনে করছেন তাঁরা। নরেন্দ্র মোদি- অমিত শাহ জুটির সাংগঠনিক নীতি অনুযায়ী ‘জুলু’বাবুর আর টিকিট পাওয়ার সুযোগ নেই।সেক্ষেত্রে তপন শিকদারের পর রাজ্যে বিজেপির অন্যতম জনপ্রিয় নেতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ইলেকশন এজেন্ট হওয়া, সবচেয়ে ভালো ‘ফেয়ারওয়েল’ বলেও মত ‘জুলু’ অনুগামীদের। বিজেপির কাছে কৃষ্ণনগরের অন্য একটি গুরুত্ব আছে।শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ এই কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে।বাংলার বিপুল সংখ্যক বৈষ্ণবকে প্রভাবিত করতে ও মতুয়া সহ অনগ্রসরদের ভোট টানতে নবদ্বীপের জুড়ি মেলা ভার। সংঘ পরিবারের জাতিভেদ বিরোধী ও একইসঙ্গে নরম হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাতেও মাপে মাপে এঁটে যায় নবদ্বীপের স্থান মাহাত্ম্য ও গরিমা।
তাই ‘প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র’ হয়ে ওঠার বড় দাবিদার কৃষ্ণনগর।
বড় সংখ্যার হিন্দিভাষী ও অবাঙালি মানুষের ভোট আছে শ্রীরামপুর ও বারাকপুর কেন্দ্রে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংখ্যালঘু তোষণে’ যাঁরা ‘বিরক্ত’ ও ‘ক্ষুব্ধ’ বলেই বিজেপির হিসেব। তাই নরেন্দ্র মোদির জন্য এই দুটি আসনও ভালো বলে সওয়াল করছেন মূলত অবাঙালি রাজ্য নেতারা।কিন্তু,এতে খুব একটা সায় নেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বাঙালি নেতাদের।পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ‘হিন্দিভাষী’ ও ‘মারোয়াড়িদের দল’-এর পরিচিতি থেকে বের করে আনতে অত্যন্ত সচেষ্ট সংঘ। প্রকৃতপক্ষে এতদিন এই পরিচিতির জন্যই প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের রাজ্যে বাড়তে পারেনি জনসংঘ ও বিজেপি, এমনটাই মত শীর্ষ নেতৃত্বের। তাই,বিজেপির
‘বেঙ্গলাইজেশন’-এর সময়, অবাঙালি ভোটের ভরসায় প্রধানমন্ত্রীকে প্রার্থী করলে ‘ভুল বার্তা’ যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেই মত; অমিত শাহদের। তবে প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র হয়ে ওঠার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে কলকাতা-উত্তর। রাজ্য রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র এমনিতেই সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের নজরে থাকে। তার উপর প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রার্থী হলে প্রচারের আলো শুষে নিতে পারবে একদা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কেন্দ্র। ‘জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতার কেন্দ্র’ এটা অবশ্যই কলকাতা-উত্তরের ক্ষেত্রে বাড়তি আবেগ যোগ করবে নরেন্দ্র মোদির জন্য। ট্র্যাডিশনাল অবাঙালি ভোটের সঙ্গে যেখানে ব্যবসায়ীদের ভোট আর সংখ্যালঘু ভোটও বড় ফ্যাক্টর। বারাণসীর মতই গলি-ঘুঁজিতে অসংখ্য মন্দির, রাজ্যে আরএসএস হেডকোয়ার্টারস কেশব ভবন, প্রধানমন্ত্রীর আইডল স্বামী বিবেকানন্দর সিমলেপাড়ার বাড়ি,বাগবাজারে মা সারদার বাসভবন উদ্বোধন, ভগিনী নিবেদিতার স্কুল ও বাড়ি–প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেগের ঝুড়ি উপুড় করে দেওয়ার মত উপাদানে ঠাসা কলকাতা-উত্তর। শেষ পর্যন্ত এই জমানার নিয়ম মেনে, মোদি-শাহ জুটিই নির্দিষ্ট আসনটি বেছে নেবেন।তবে আপাতত উত্তর কলকাতার পাল্লা ভারী একথা বলাই যায়। সবশেষে পড়ে থাকে, প্রধানমন্ত্রী কেন বারাণসী ছেড়ে কলকাতায় লড়তে আসবেন? এমন আপাত অসম্ভব সিদ্ধান্ত তো কেবল আবেগ নির্ভর হতে পারে না! রাজনৈতিক যুক্তিটা ঠিক কী?
উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী বারাণসী ‘ছেড়ে’ না-ও আসতে পারেন। মোদি, বারাণসীর সঙ্গেই এ রাজ্যের একটি আসনে প্রার্থী হতে পারেন।দ্বিতীয়ত,শাসক তৃণমূলের ‘রিগিং’ ও ‘সন্ত্রাস’ মোকাবিলায় এটাই সেরা কৌশল মনে করছেন, মোদি-শাহ জুটি।প্রধানমন্ত্রী এ রাজ্য থেকে ভোটে লড়লে,নির্বাচন কমিশন সহ রাজ্যের আইএএস-আইপিএস মহল অসম্ভব চাপে থাকবে। সরাসরি বিজেপির পক্ষে না হলেও, তৃণমূলের পক্ষেও কাজ করা সম্ভব হবেনা তাদের পক্ষে। তৃতীয়ত,বাংলায় ফিরি করা হবে বাঙালির সবচেয়ে বড় ‘অপূর্ণ সাধ’, পূরণের স্বপ্ন। ‘বাংলা থেকে ভোটে জিতে কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন।’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে জ্যোতি বসু হয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়।সুকৌশলে তুলে ধরা হবে বাঙালির ‘ধারাবাহিক বঞ্চনা’-র ইতিহাস। সামনে আনা হবে ‘যোগ্য’ হয়েও বারবার বাঙালির প্রধানমন্ত্রিত্ব না পাওয়ার পিছনে, কংগ্রেস-কমিউনিস্ট মিলিত ‘ষড়যন্ত্রে’র তত্ত্ব। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ধারনা, এতে শুধু মোদি জিতবেন না। একটা ‘ওয়েভ’ উঠবে।যে ঢেউয়ে ‘ভেসে যাবে’, দু’টাকার চাল থেকে কন্যাশ্রী– মমতার যাবতীয় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ডিভিডেন্ড।থমকে যাবে,’উন্নয়নের জোয়ার’। চতুর্থত, মোদি এ রাজ্যে, বিশেষত,উত্তর কলকাতায় প্রার্থী হলে,চাপে পড়বেন মমতা।কলকাতা ও আশপাশের বাইরে খুব বেশি ছুটতে পারবেন না। ‘ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলা’ প্রধানমন্ত্রী, দক্ষিণ কলকাতাতেও নিজের খাস তালুকে ‘প্রেস্টিজ ফাইটে’ মুখ্যমন্ত্রীর বড় মাথাব্যাথা হয়ে উঠবেন বলেই বিজেপির বিশ্বাস।
সবশেষে, প্রচারে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবহারের প্রশ্নেও সুবিধা হবে তাঁর দলের। ২০১৯-অসম,ওড়িশা সহ পূর্ব ভারতের ১৩১টি লোকসভা আসন বিজেপির লক্ষ্য।কারণ,দেশের বাকি অংশে বিজেপি নিজেদের সেরাটা দিয়ে ফেলেছ। সেখানে নিজেদের সাফল্য ধরে রাখাই তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ। আসন বাড়াতে ভরসা তাই পূর্ব ভারত।নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী হলে, এ রাজ্যের সঙ্গেই প্রচারে তাঁকে অসম,ওড়িশায় ব্যবহার করাও সহজ হবে।
সবমিলিয়ে,যুক্তি ও আবেগের মিশেলে নরেন্দ্র মোদির এ রাজ্য থেকে ভোটে লড়ার ঘোষণা তাই সময়ের অপেক্ষা বলেই ধারনা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিজেপির একাংশের।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন :