মমতা-সুদীপ বিরোধের সেই দিনে ফয়দা তুলল সিপিএম –
সঞ্জয় সিংহ
( জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) :
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তখন মন কষাকষি চলছে। ২০০৪ সালে লোকসভা ভোটের ঠিক আগের কয়েকমাসের ঘটনা। তৎকালীন এনডিএ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তথা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সুদীপের সম্পর্ক ভীষণ ভাল। তৃণমূল নেতাদের একটা বড় অংশই মনে করেছেন, মমতাকে ডিঙিয়ে সুদীপ ‘কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন’। ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি তৃণমূল নেত্রীও।
আমরা কয়েকজন সাংবাদিক লক্ষ করলাম, কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট বা তপসিয়ার তৃণমূল ভবনে সুদীপবাবুকে যেমন দেখা যাচ্ছে না, তেমনই তাঁকে নিয়ে নেত্রী থেকে নেতারা খোলাখুলি কোনও আলোচনাই করছেন না। এই প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যারে সুদীপবাবু তিন দিনের স্বাস্থ্যমেলা করলেন। সেই স্বাস্থ্যমেলা শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তপসিয়ায় গোলাম জিলানি খান রোডে কলকাতা পুরসভার এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে পাশে বসিয়ে মমতা ঘোষণা করলেন, তপসিয়ার চৌবাগায় এবং তপসিয়ার ফুটবল মাঠে দু’টি স্বাস্থ্যমেলা হবে।
রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যারে সুদীপবাবু স্বাস্থ্যমেলার আয়োজন করেছিলেন নিজের সাংসদ তহবিলের টাকায়। তপসিয়ার পুরসভার অনুষ্ঠানে মমতা ঘোষণা করলেন, “আমার সাংসদ তহবিলের টাকায় তপসিয়ায় দুটো স্বাস্থ্যমেলা হবে।” আর সুদীপবাবুর স্বাস্থ্যমেলা কতখানি গুরুত্বহীন তা বোঝাতে তৃণমূল নেত্রী কটাক্ষ করলেন, “স্বাস্থ্যমেলা সেখানেই হওয়া উচিত, যেখানে জনবসতি বেশি। যেখানে গরিব মানুষের বসতি রয়েছে। এই যেমন তপসিয়া এলাকা। এখানে স্বাস্থ্যমেলার গরিব মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাতে পারবেন।”
তপসিয়া পুরসভার অনুষ্ঠানে ছিলাম। আমি তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় রাজনৈতিক সাংবাদদাতা। অনুষ্ঠানের পর অফিসে ফিরে খবর নিয়ে আলোচনার সময় সম্পাদকীয় বিভাগের কর্তারা সব শুনে বললেন, “আরে এ তো দারুণ স্টোরি। স্বাস্থ্যমেলাকে কেন্দ্র করে সুদীপ-মমতার কাজিয়া প্রকাশ্যে! দারুণ খবর!”
আমি কপির প্রথম লাইনে লিখেছিলাম— শেষপর্যন্ত দলীয় সঙ্গী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে হাঁটতে চলেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখটির হেডিং হয়েছিল— সুদীপকে টেক্কা দিতে দু’টি স্বাস্থ্যমেলা মমতার।
আর যায় কোথায়? অগ্নিতে ঘৃতাহুতি! লেখা বেরনোর পরেই জরুরি সাংবাদিক বৈঠক ডাকল তৃণমূল। দুপুর বেলা। তৃণমূল ভবনে। মমতাদির মুখ-চোখ লাল। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়দের পাশে বসিয়ে সংবাদমাধ্যম (লক্ষ্য আমি), ব্যাপক ক্ষোভ উগরে দিলেন মমতা। প্রশ্ন তুললেন, এটা কোন ধরনের সাংবাদিকতা হচ্ছে? দীর্ঘদিনের পরিচয় ও বন্ধুত্বের খাতিরে কোনও দিন মমতাদি আমাকে কোনও কুট কথা বা সমালোচনা করেননি। কিন্তু সুদীপবাবুকে কেন্দ্র করে এমনিতেই চটে ছিলেন। তৃণমূল নেত্রী তাঁর ওপর ওই লেখা প্রকাশিত হওয়ায় সেদিন সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পর মমতাদি সোজা আমার সামনে চলে এলেন। আমার পাশে বসেছিলেন অধুনা বিধায়ক তখন সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল। মমতাদি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “এই আপনাদের মতো সাংবাদিকদের জন্য সিপিএম এখনও বহাল তবিয়তে বাংলায় রাজ করছে। করে কম্মে খাচ্ছে।” আমি তো হতবাক! মমতাদি হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর পিছু নিলেন অন্য নেতারা।
এরপর জল অনেক দূর গড়াল। অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হল দু’পক্ষের। সুদীপবাবুকে ছ’বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হল। সুদীপকে ঘায়েল করতে তৃণমূল নেত্রী বেছে নিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। সেবার ভোটে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে সুদীপবাবুকে সরিয়ে মমতা তৃণমূলের প্রার্থী করলেন সুব্রতবাবুকে। কংগ্রেসের সমর্থনে জোড়া মোমবাতি প্রতীক চিহ্ন নিয়ে সুদীপবাবু একই কেন্দ্রে দাঁড়ালেন।
সেই ভোটে বাম বিরোধী দুই হেভিওয়েট সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট কাটাকাটিতে লাভবান হলেন বামফ্রন্ট প্রার্থী সিপিএমের সুধাংশু শীল। তিনি জিতে সাংসদ হলেন।
সুদীপবাবুকে ‘টাইট’ দিতে যে-সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে তৃণমূল নেত্রী ব্যবহার করেছিলেন, কাছে টেনেছিলেন, সেই সুব্রতবাবুর সঙ্গে তাঁর কয়েকমাসের মধ্যেই বিরোধ বাধল মমতাদির। কেন এবং তাঁর পরিণতি কী হল জানাব আগামী সংখ্যায়।