কমলেন্দু সরকার :
রামায়ণের অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র হনুমান। হনুমানের জন্মকাহিনি মানুষের মনে ঔৎসুক্য জাগাবে। সুন্দরী অপ্সরা পুঞ্জিকাস্থলা। এক ঋষির অভিশাপে বানর কুঞ্জরের কন্যা হিসেবে জন্ম নিলেন পুঞ্জিকাস্থলা। তাঁর নাম হল অঞ্জনা। অঞ্জনার বিয়ে হল কেশরীর সঙ্গে। একদিন অঞ্জনা সুন্দরী মহিলার রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন পাহাড়ে। অঞ্জনার রূপে মুগ্ধ এবং কামার্ত হয়ে পড়লেন পবনদেব। তিনি অপহরণ করলেন অঞ্জনাকে। কামার্ত পবনদেবের সঙ্গে অঞ্জনার মিলন ঘটল। গর্ভাধান করলেন অঞ্জনার।
অঞ্জনার কিছু করার ছিল না। পবনদেব বললেন, তোমার যে পুত্র জন্মাবে সে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বীর্যবান, ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন, বড় চেহারার বলশালী, ওপর দিকে বিশাল লাফ দেওয়ায় ক্ষমতাশালী।
সময় হলে এক পাহাড়ের গুহায় পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন অঞ্জনা। শিশু অবস্থায় পুব আকাশে উদিত সূর্যকে ফল ভেবে বিশাল এক লাফ দিল অঞ্জনা-পুত্র! দেবরাজ ইন্দ্র সেইসময় তাকে ওইভাবে যেতে দেখেন। দেবরাজ রেগেমেগে বজ্র নিক্ষেপ করলেন অঞ্জনা-পুত্রকে। ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে তার বাঁ দিকের চোয়াল গেল ভেঙে। পড়ল পাহাড়ের ওপর। বাঁ চোয়াল বা হনু ভেঙে যাওয়া থেকে তার নাম হল হনুমান।
পাহাড়ের ওপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পবনদেব ভাবলেন তাঁর পুত্র মৃত। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যাতায়াত বন্ধ করলেন স্বর্গ, মর্ত আর পাতালে। দেবতারা সবাই পড়লেন মহাফাঁপরে। তাঁরা ভয় পেয়ে শুরু করলেন পবনদেবের সন্তুষ্টিস্তব। শান্ত এবং প্রসন্ন হলেন পবনদেব। পবনন্দন হনুমানকে বর দিলেন ব্রহ্মা—- কোনও অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হবে না। ইন্দ্র বর দিলেন—- স্বইচ্ছায় তার মৃত্যু। দু’জনার বরে ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন পবনদেবের ঔরস এবং কেশরীর ক্ষেত্রজ পুত্র।
নিজের ইচ্ছানুসারে চেহারা এবং রূপ ধারণ করতে পারা হনুমান তাঁর বানররূপ ত্যাগ করে সন্ন্যাসীরূপ নিলেন। এরপর রাম-লক্ষ্মণের কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন। রামচন্দ্র মুগ্ধ হলেন হনুমানের কথাবার্তায়। অত্যন্ত পণ্ডিত না হলে এমন কথা বলা যায় না তা বুঝলেন। ঠিক হল বর্ষা শেষ হলেই সীতার খোঁজে বেরনো হবে। তারপর রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হবে। হনুমানের পরিচালনায় উপস্থিত হল বিশাল বানরবাহিনী। রামচন্দ্রের ভরসা হনুমানই। রামচন্দ্র নিজের নাম লেখা একটা আংটি দিলেন তাঁর হাতে। সীতামায়ের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে দিতে হবে। শ্রীরামচন্দ্রের চরণবন্দনা করে রওনা দিলেন হনুমান।
চারিদিকে সীতামায়ের খোঁজ শুরু করে দিলেন হনুমান। কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না সীতার। হনুমান খবর পেলেন সমুদ্রের মাঝে লঙ্কা নামে এক দ্বীপে বাস করেন রাবণ। ওখানেই সীতামাকে বন্দি করে রেখেছেন। হনুমান উঠলেন মহেন্দ্র পর্বতের ওপর। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পবনদেব সকলকে স্মরণ এবং প্রণাম করলেন। তারপর নিজের শরীরটা প্রকাণ্ড করে বিশাল এক ঝাঁপ দিলেন শূন্যে। হনুমানকে আকাশপথে উড়ে যেতে দেখে রাক্ষসী সিংহিকা তাঁকে গিলে খেতে এল। হনুমান তৎক্ষণাৎ নিজের শরীর ছোট করে নিয়ে রাক্ষসীর মুখের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেলেন। তারপর দাঁত, নখ দিয়ে রাক্ষসীর শরীর ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে এলেন। মৃত্যু হল রাক্ষসী সিংহিকার।
আবার আকাশ চলা শুরু করলেন হনুমান। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর হনুমান দেখলেন রাক্ষস প্রহারায় লঙ্কাপুরী। বিশাল চেহারা নিয়ে ঢুকতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিড়ালের মতো নিজেকে করে প্রবেশ করলেন লঙ্কাপুরী। কিন্তু ধরা পড়লেন সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে। হনুমান নিজের পরিচয় আর আগমনের উদ্দেশ্য গোপন রেখে বললেন, সুন্দর এই লঙ্কাপুরী ঘুরে দেখতে চান। কিন্তু ভয়ংকররূপী দেবী সজোরে মারলেন হনুমানকে। দেবীর এমন ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হনুমান আঘাত করলেন দেবীকে। নারী হত্যা মহাপাপ তাই নিজেকে নিবৃত্ত রাখলেন। হনুমানের ওই সামান্য আঘাতে দেবী পরাস্ত হলেন।
হনুমান রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ঢুকলেন লঙ্কাপুরী। চারিদিকে রাক্ষস প্রহরা। বহু রমণী তাঁর চোখে পড়ছে কিন্তু কাউকেই তো সীতামা বলে মনে হচ্ছে না! একটি ঘরে দেখেন মণিমাণিক্য দেওয়া সোনার খাটে ঘুমোচ্ছেন রাবণ। ঘুরতে ঘুরতেই চোখে পড়ল অশোকবন। হঠাৎই দেখলেন একটি অশোক গাছের নীচে কয়েকজন রাক্ষসী প্রহরায় রয়েছেন এক রমণী। তাঁর জীর্ণ বসন। মাঝে মাঝেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, কাঁদছেন। হনুমানের মনে হল ইনিই আমার সীতামা। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একঝলক সীতাকে দেখেছিলেন ঋষ্য পর্বত থেকে। হনুমানের আর সংশয় রইল না।
রাত কেটে সকাল হলে সীতা যে-গাছের নীচে বসেছিলেন সেই গাছের একটি ডালে এসে বসলেন হনুমান। নিজের শরীরটি একদম ছোট করে নিয়ে পাতা আড়ালে থেকে রাম-লক্ষ্মণের প্রশংসা আর রামগান করতে লাগলেন। রাম-লক্ষ্মণের সংবাদে খুশি হলেন সীতা। কিন্তু সীতা এটা আবার রাবণের নতুন কোনও ছলনা নয়তো! সীতার মন থেকে সংশয় কাটানোর জন্য রামচন্দ্রের দেওয়া আংটটি সীতামায়ের হাতে তুলে দিলেন। রামচন্দ্রকে দেওয়ার জন্য সীতা দিলেন তাঁর শিরোভূষণ। হনুমান বললেন, খুব শিগগির রাবণ বধ করে তাঁকে উদ্ধার করবেন শ্রীরামচন্দ্র।
যে-কারণে লঙ্কাপুরী আসা হনুমানের সেই উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় তাঁর মনে আনন্দ আর ধরে না। তাই নিজের শক্তি প্রদর্শনের লন্ডভন্ড করলেন তিনি লঙ্কাপুরী। প্রহরারত রাক্ষসেরা বাধা দিলে কেউই এঁটে উঠতে পারল না হনুমানের সঙ্গে। এমনকী রাবণ-পুত্র ইন্দ্রজিৎও নয়। হনুমান বললেন রাবণকে, সীতাকে সসম্মানে রামচন্দ্রের কাছে ফিরিয়ে দিতে। এই কথায় রাবণ রেগে গিয়ে নির্দেশ দিলেন, হনুমানকে বধ করার জন্য। হনুমান অবধ্য একথা রাবণকে বোঝালেন ভাই বিভীষণ। তখন রাবণ আরও রেগে গিয়ে বললেন, হনুমানের লেজে আগুন ধরিয়ে দিতে। তাই হল। আগুন-লাগা লেজ নিয়ে হনুমান তোলপাড় করে দিলেন লঙ্কাপুরী। লঙ্কাপুরী জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল। পরে হনুমান সমুদ্রের জলে লেজ নেবালেন।
কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে রাম, লক্ষ্মণ, সুগ্রীবকে সবিস্তারে বললেন হনুমান। এও বললেন, লঙ্কাপুরী অত্যন্ত সুরক্ষিত। এখানেই সকলে হাজির। যাত্রা শুরু হল। হনুমান পিঠে নিলেন রামচন্দ্রকে আর অঙ্গদ নিলেন লক্ষ্মণকে। সবাই এলেন সমুদ্রের বালিয়াড়িতে।
অন্যদিকে লঙ্কাপুরীতে বিভীষণ বোঝালেন দাদা রাবণকে, পরস্ত্রীকে অপহরণ করা তাঁর মতো জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়। লঙ্কাপুরীর মঙ্গলের জন্য রামচন্দ্রের কাছে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়াই সমীচীন হবে।
ওদিকে লঙ্কাপুরী যাওয়ার সুবিধার জন্য সমুদ্রের ওপর সেতুবন্ধনের কাজে লেগে পড়লেন বিশ্বকর্মার পুত্র এবং সুগ্রীবের অন্যতম সেনাপতি নল। রামচন্দ্র বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন লঙ্কাপুরী। যুদ্ধ শুরু হল রাম-রাবণের। এই মহাযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন হনুমান। তিনি দায়িত্ব নিলেন লঙ্কাপুরীর পশ্চিমদ্বারের প্রধান হিসেবে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লঙ্কাপুরীর সমস্ত বীরই মারা গেলেন। রাবণ হত হলেন সাংঘাতিক যুদ্ধের পর। রাবণবধের খবর অশোকবনে সীতাকে দিলেন হনুমান। হনুমানের ভূমিকায় খুশি রামচন্দ্র আলিঙ্গন করলেন তাঁকে।
অন্যদিকে লঙ্কায় অভিষেক হল বিভীষণের। পুনর্মিলন হল রাম-সীতার। অযোধ্যার পথে রওনা দিলেন সকলেই। রামচন্দ্র বললেন হনুমানকে, যতদিন পৃথিবীতে রামকথা প্রচলিত থাকবে ততদিন হনুমানের কীর্তিও থাকবে বিদ্যমান। হনুমান বললেন, যতদিন পৃথিবীতে রামচন্দ্রের কীর্তি প্রচলিত থাকবে ততদিন হনুমান তাঁর আদেশ প্রতিপালন করবেন। হনুমান ছিলেন রামের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি রামচন্দ্রের জন্য অসাধ্যসাধন করেছিলেন। রামচন্দ্র নিজেও স্বীকার করেছিলেন হনুমানের কথা। হনুমানের গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না, যায়ও না! হনুমান পূজিত হন দেবতারূপেও।
লাইক, শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন