‘ঝড়ের ঠিকানা- পর্ব ১২’
সঞ্জয় সিংহ :
(জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) :
রাজনৈতিক বাধ্য-বাধকতায় এক সময় যার হাত ধরেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝলসে উঠতে দেখা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব পেতে তিনি বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। আজ তাদের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন তৃণমূল নেত্রী। অনেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘দুই মুখ’ নিয়ে সমালোচনা, কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। আাার কেউ কেউ তৃণমূল নেত্রীর এমনই দ্বৈত রূপ দেখে কিছুটা ধন্দে পড়ে যান।
আমার কিন্তু মনে হয় মমতাদির এই চারিত্রিক বৈপরীত্য নিয়ে ধন্দ, বা কোনও অষ্পষ্টতা নেই। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মমতাদি প্রথম থেকেই আপাদমস্তক প্রতিবাদী। কোথাও কোনও অন্যায়, অবিচার এবং মানবিকতা লঙ্ঘিত হলে তিনি চুপ করে থাকেন না। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিনতি কি হতে পারে তা বিবেচনা না করেই তিনি প্রতিবাদে ঝাপিয়ে পড়েন বলে অনেকে মনে করেন। আমার অবশ্য মনে হয় মমতাদি যা করেন তা হিসেব কষেই করেন। আজ তিনি এ জায়গায় পৌছেছেন, হিসেব কষা না থাকলে এই জায়গায় তিনি থাকতেন না।
বরাবরই মমতাকে প্রতিবাদী চরিত্রে মানুষ দেখেছ। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনে তাঁর অনমনিয় চেহারা দেখার আগে বিভিন্ন বিষয়ে রাজপথে নেমে তাঁকে প্রতিবাদ করতে দেখেছে মানুষ। পুলিশ হেফাজতে বন্দি মৃ্তুর প্রতিবাদে রাজপথে ধর্ণা অবস্থান থেকে শুরু করে, নদিয়ার মুক বধির কিশোরী দিপালী বসাককে নিয়ে মহাকরণে মুখমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরের সামনে অবস্থান করেছেন মমতাদি। সেই অবস্থান তুলতে পুলিশ তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মহাকরণ থেকে বার করে লালবাজারে নিয়ে যাচ্ছেন এটা বহু মানুষের চোখের সামনে ঘটেছিল। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে এই ঘটনা যখন ঘটছে মমতাদি তখন সাংসদ। কয়েক মাস আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে আগের মতো সেদিনও তাঁকে আমরা পিছু হঠতে দেখেনি।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগের কথা, তিনি তখন সদ্য সাংসদ হয়েছেন। আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের দাবিতে, কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ভেঙ্গল রাওয়ের দফতরের সামনে মমতাদি অনশনে বসেছিলেন। এটাতো কিছুই নয়, ১৯৮৬ সালে পরের পর ঘটনায় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার তো বটেই, দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বকেও রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল মমতাদি। ১৯৮৪ সালে যাদবপুর থেক জয়ী হয়ে মমতাদি প্রথম সংসদে গিয়েছিলেন। আর সেই সময় সেখানকার মানুষের দাবি ছিল, ‘নি:শর্ত জমির দলিল দিতে হবে।’ সেই দাবি আদায়ের জন্য সংসদে রীতিমতো তুলকালাম বাধিয়ে দিয়েছিলেন যাদবপুরের সাংসদ। তত্কালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংয়ের সঙ্গে কার্যত যুদ্ধ করেছিলেন মমতাদি। এমনকি বুটা সিংয়ের পদত্যাগের দাবি করে হইচৈই করে দিয়েছিলেন তিনি। মমতাদির বক্তব্য ছিল ‘‘আমি নির্বাচনী প্রচারে নি:শর্ত জমির দলিলের দাবি সামনে রেখে লড়েছিলাম। মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিলাম। সেটা কি ছেড়ে দেওয়া যায়!’’ লড়াইতে জিতেছিলেন তিনি। মমতাদির কথায় ‘‘আমার দাবি মেনেই বুটা সিংজি স্বয়ং যাদবপুরে এসে উদ্বাস্তুদের জন্য নি:শর্তে জমির দলিল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ’’
এখানেই শেষ নয় ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সালে বেশ কয়েকবার দলীয় নীতির বাইরে গিয়ে বিরোধী সাংসদদের সঙ্গে একজোট হয়ে সরব হয়েছিলেন মমতাদি। সবই করেছিলেন বাংলার স্বার্থেই। একবার দিল্লির সরকার রাজ্য়ে কেন্দ্রীয় ছাপাখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতিবাদে সংসদ থেকে ‘ওয়াক আউট’ করেছিলেন মমতাদি। ওই সময় বিরোধী সাংসদরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। আবার দলের নিষেধ অমান্য করে হলদিয়া পেট্রেো কেমিক্যালসে অনুমোদনের জন্য় পূর্বাঞ্চলের বাম সাংসদের নিয়ে কেন্দ্রের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন মমতাদি। পরে এসব নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন ‘‘ সব করেছি রাজ্য়ের স্বার্থে, বাংলার মানুষের স্বার্থে।’’
এখন দিল্লির বিজেপি সরকারের ‘অমানবিক কাজের’ প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে কসুর করছেন না তৃণমূল নেত্রী। তাঁর কথায় ‘‘ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একের পর এক জন বিরোধী কাজ করে চলেছে। তার প্রতিবাদ করতেই হবে। হঠাত করে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিল। কে কি খাবে তা নিয়ে ফতয়ো জারি হচ্ছে, এর প্রতিবাদ তো করতেই হবে। ’’ তাঁর অভিযোগ প্রতিবাদ করা হচ্ছে বলেই তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে একের পর এক সিআইডি, ইডি, আয়কর দফতর দিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।’’
বস্তুত মুখ্য়মন্ত্রী হয়ে রাজ্য় পরিচালনা করলেও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে এখনও তিনি পিছিয়ে থাকেননা। অবশেষে তাঁর দলের নেতাদের একটা বড়ও অংশের অভিমত দিদি অন্য়ায়ের সঙ্গে কখনোই আপোস করতে পারেননা। আর সেই কারণেই একদিন কংগ্রেস নেতৃত্বর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে নতুন দল তৈরি করতেও সময় নেননি তিনি। অনেকে বলেন মমতা কংগ্রেস ছেড়েছিলেন। কথাটা আক্ষরিক অর্থে সঠিক নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বই তাঁকে দল থেকে তাড়িয়েছিল। কিন্তু রাজনীতি কি বিচিত্র! আজ বিজেপিকে ঠেকাতে সেই মমতাদিই কংগ্রেসের হাত শক্ত করে ধরতে যাচ্ছেন। মজার ব্য়াপার এ কংগ্রেসকে বাংলায় ‘সাইন বোর্ডে’ পরিনত করতে তিনি ও তাঁর দল উঠে পড়ে লেগেছে, জাতীয় রাজনৈতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা সে রাষ্ট্রপতি, উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হোক অথান সংসদে বিজেপি সরকারের জনিকরোধী নীতি রূপায়নে বাধা দিতেই হোক কংগ্রেসের সঙ্গে হাতেহাত মিলিয়েই চলছেন মমতাদি এবং তাঁর দল।
কেন এমন হচ্ছে! এই প্রশ্নে তাঁর ঘনিষ্ট সহকর্মী থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেরই অভিমত, ‘‘এটা কোনও নতুন ব্য়াপার নয়, একদিন যাদের বিরুদ্ধে মমতা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন পরবর্তী সময়ে তাদের কাছে টেনে নিয়েছেন। এটাই মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ইউএসপি।’’
অবশ্য় মমতাদির এমন বৈপরীত্য়ই তাঁর একদা প্রতিপক্ষ অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছেন। সেই কাহিনী শোনাবো পরেরবার।