বিশ্রাম নেওয়া হল না মমতার
সঞ্জয় সিংহ :
(জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) :
লড়াই করার মানসিকতাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জীবন শক্তি’ বলেই আমার মনে হয়। অন্তত যে ৩৩ বছর ধরে মমতাদির সঙ্গে আমার পরিচয় তাতে মনে হয়, উনি একা থাকুন বা লাখো লাখো মানুষের আবেগের সওয়ারি হন, লড়াই ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতে পারেন না।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে যখন তাঁর দল পর্যদুস্তু। মমতাদি নিজেও ভাবছেন, ক’দিন বিশ্রাম নিয়ে নতুন রাজনৈতিক কৌশল করে সিপিএম শাসিত বাংলায় মাথা তুলতে হবে। নতুন করে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। কারণ, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। প্রায় একাই সংগঠনকে টেনে নিয়ে চলেছেন মমতাদি। সেখানে আন্দোলন করে দলকে চাঙ্গা রাখতেই হবে।
ঠিক এইরকম সময়েই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার এক মোক্ষম অস্ত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন। ২০০৬ সালের ভোটের সময় থেকেই বুদ্ধবাবুরা আওয়াজ তুলেছিলেন, “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।” বলতে শুরু করেছিলেন, শিল্পে জোর দিতে হবে।
সপ্তমবারের জন্য বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেই তাদের কৃষিকে ভিত্তি করে যেমন শিল্পের ভবিষ্যৎ গড়ছেন তা পরিষ্কার হয়ে গেল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরই! বুদ্ধবাবু রাজভবন থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে মহাকরণে চলে এলেন। একদিন কংগ্রেস নেতাদের কটাক্ষ করে যে সিপিএম শ্লোগান দিত, ‘টাটা / বিড়লার কোলে, অতুল্য-প্রফুল্ল দোলে’, সেই টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার সঙ্গে মহাকরণে ‘চা খাওয়া’র আয়োজন করেছেন বুদ্ধবাবু। সেই ‘টি পার্টি’র পরই বুদ্ধবাবু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন, সিঙ্গুরে মোটর গাড়ি কারখানা তৈরির জন্য টাটাদের জমি দেওয়া হবে। ওই সমস্ত জমিই কিন্তু উর্বর, কৃষিজমি হিসেবেই চিহ্নিত। মমতাদি কি আর চুপ করে থাকতে পারেন?
আমার মনে আছে, ওই সময় এক বিকেলে মমতাদি আমাদের বলেছিলেন, “না, আর আমার বিশ্রাম নেওয়া হল না।” টাটাদের হাতে সরকারের জমি তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে সিঙ্গুরের কৃষকদের একটা বড় অংশ যেমন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনই সিপিএম বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদে সরব হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল গণ সংগঠন, ‘সিঙ্গুরের কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি।‘ বহু আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সঠিক সময় বুঝে নিতে ভুল করেননি, কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলন তাঁর হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে।
একদিন কালীঘাটে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের খুপরি ঘরে বসে মমতাদি আমাদের বললেন, “সিপিএম কি বাংলার মাটিতে ওদের জমিদারি পেয়েছে। এরা তো রীতিমতো মাৎস্যন্যায় করছে।” আমি তখন কলকাতার এক বহুল প্রচারিত সাংবাদপত্রের রাজনৈতিক সংবাদদাতা। সেই সাংবাদপত্র টাটাদের মোটর কারখানা তৈরির ব্যাপারে উৎসাহী। আমাদের কাগজের নাম না করে মমতাদি বললেন, “ওরা (সংবাদপত্র) এখন ব্র্যান্ড বুদ্ধর ব্যান্ড বাজাচ্ছে। কিন্তু ওরা কি বুঝেছে না, সিপিএমের আমলে রাজ্যে ৫৫ হাজার বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লক্ষাধিক ছোট কারখানাও বন্ধ। এক কোটির ওপর বেকার।” একটু দম নিয়ে বললেন, “আর সিঙ্গুরের চাষিদের জমি নিলে দেড় লক্ষ কৃষক, খেতমজুর কাজ হারাবেন!” তিনি যে বড়সড় আন্দোলনের পথে নামছেন তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলাম।
ইন্দোনেশিয়ার সালিম গোষ্ঠীকে জমি দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূল ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমেছে। আলিপুর থানা এলাকায় তাজ বেঙ্গল হোটেলে যেখানে সালিম গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এসে উঠেছেন সেখানে মমতাদির নির্দেশে তৃণমূল নেতৃত্ব, বিশেষ করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্ষোভ দেখিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। সালিমরা দক্ষিণ ২৪ পরগণায় সড়ক, সেতু নির্মাণের বরাত নিয়েছিল।
সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ তখন টাটাদের হয়ে সওয়াল করছেন। শাসক দল তো বটেই, কংগ্রেস নেতাদের একাংশও টাটাদের সমর্থন করছে। মমতাদি কিন্তু সমস্ত সমালোচনাকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর একটাই কথা, “আমি শিল্পের বিরোধী নই। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী সিপিএম কেন উর্বর জমি কেড়ে নিচ্ছে অনিচ্ছুক চাষীদের কাছ থেকে? বহু অনুর্বর জমি পড়ে আছে। শিল্পের জন্য তা কেন নিচ্ছে না?”
জুন মাসের এক বর্ষামুখর বিকেলে আন্দোলনে নামলেন ‘বাংলার অগ্নিকন্যা’। সেই আন্দোলন উত্তাল চেহারা নিল ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৬ রাতে। সেদিন রাতে অনেকেরই স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছিল ১৬ বছর আগে হাজরা মোড়ের ঘটনাকে। কী ঘটেছিল হাজরায়? পরের সংখ্যায় জানাব।