সুমন ভট্টাচার্য :
কাশ্মীর। ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত। আপাতত এই তিনটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। আর এই বিতর্ককে আরও খুঁচিয়ে তুলেছেন কলকাতার কিছু বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং তাত্ত্বিক। কলকাতার এক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী দিল্লির ইংরেজি পোর্টালে কলম লিখে ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতকে জালিওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শুধু তুলনা করেই থামেননি, দেশজোড়া নিন্দের ঝড়ের মাঝেই সেই বামপন্থী তাত্ত্বিক নিজের বক্তব্যে অনড় থেকেছেন। আর অতি সম্প্রতি সেই বামপন্থী তাত্ত্বিকের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় গলা ফাটিয়ে চলেছেন সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত আর এক তাত্ত্বিক যুবনেতা। বামপন্থী এবং তথাকথিত উদারপন্থীদের এই ‘ব্যান্ডওয়াগন’-এ যোগ দিয়েছেন কলকাতার কিছু কলমচি এবং সম্পাদকও।
স্বভাবতই এই সব বিতর্ক নিয়ে জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ঝড় বয়ে গেলেও সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত টুঁ শব্দটি করেননি। এমনকী যখন কংগ্রেসের এর প্রাক্তন সাংসদ সন্দীপ দীক্ষিত তাঁকে ‘সড়ক কা গুন্ডা’ আখ্যা দিয়েছেন, তখনও বিপিন রাওয়াত কিছু বলেননি। দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের পুত্র সন্দীপ দীক্ষিতকে অবশ্য তাঁর মন্তব্যের জন্য চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়েছে। দিল্লির গুঞ্জন অনুযায়ী, সনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর নির্দেশেই সন্দীপ দীক্ষিতকে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে ‘অসম্মানজনক মন্তব্য’-এর জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছে। আসলে এমনিতেই জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা কংগ্রেসের পক্ষে ভারতীয় সেনা বা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে কিছু বলাটা মুশকিল। বরং কংগ্রেসের একটা বড় অংশ সেনাবাহিনীর ‘কাশ্মীর নীতি’র সমর্থক। সদ্য পাঞ্জাব নির্বাচনে জিতে আসা কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং তো প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়ে কাশ্মীর নিয়ে সেনাবাহিনী এবং সেনা প্রধানের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
তাহলে এই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বা তাত্ত্বিকদের সেনাবাহিনী বা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে এত বিতরাগ কেন? সেটা কি শুধুই মেজর গগৈ এর ‘মানব ঢাল’ হিসাবে এক কাশ্মীরি যুবককে ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ? নাকি, ক্রমশ জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলা বামপন্থীদের মতো বামপন্থী তাত্ত্বিকরাও নিজেদের আজকাল একটু অসহায় বলে মনে করছেন? সেই কারণেই প্রচারের যাবতীয় আলো টেনে নিতে সেনাবাহিনী বা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে এত আক্রমণ? ভারতীয় সেনাবাহিনী কিন্তু বিজেপির দ্বারা পরিচালিত নয়, বা বজরং বাহিনীও নয় যে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনায় শান দিলে নিজেদের ‘সেক্যুলার ইমেজ’এ একটু ঔজ্বল্য আসবে। তাহলে কেন এই সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’?
সমস্যা হচ্ছে, যদি কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা হয়, উরির মতো কোনও ঘটনা ঘটে তখন কিন্তু এই বুদ্ধিজীবী বা তাত্ত্বিকেরাই টেলিভিশন স্টুডিয়োর নিরাপদ দূরত্বে বসে সেনাবাহিনীর ‘কৌশলগত’ ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করে চায়ের কাপে তুফান তুলতে পারেন। একই কলমচিরা নিজেদের কলমে ‘সেনাবাহিনীর কি কি করা উচিত’, তাই নিয়ে লম্বা নিবন্ধ লিখতে পারেন। কিন্তু নিজেদের ‘এয়ারকন্ডিশন’ স্বাচ্ছন্দ্য থেকে তাঁরা কোনওদিন কাশ্মীরের বরফ কিংবা উত্তেজনার পারদ, কোনটাই মাপতে যাননি। বিপিন রাওয়াত, ভারতীয় সেনাপ্রধান, কিন্তু এদের তুলনায় অকপট। সোজা-সাপটা কথাও বলেন। কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কিন্তু পরিষ্কারই বলেছিলেন, “আমি কি করব? আমার সেনাদের বলব কোনও ব্যবস্থা নিয়ো না। তুমি যদি নিজে মারাও যাও, তাহলেও কোনও ব্যবস্থা নিও না! তোমার মৃতদেহ ফিরে এলে দেশ তোমার জন্য একটা কফিন তো দেবেই। তার সঙ্গে সেই কফিন ঢেকে দেওয়ার জন্য একটা জাতীয় পতাকা।”
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে লেখা বব ডিলানের গান সমাদৃত হয়েছিল। বব ডিলান এই বছর তাঁর গানের জন্য নোবেলও পেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ভাবছেন, কলকাতায় বসে ভারতীয় সেনা বা ভারতীয় সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে লাগাতর আক্রমণ চালিয়ে ভবিষ্যতের ‘ডিলান’ হওয়া যাবে, তারা ঠিক ভাবছেন তো? ভারতীয় সেনা যে কাজটা করতে পারে, সেই কাজটা এই বামপন্থী তাত্ত্বিকরা নিজেরা করে দেখাতে পারবেন তো?