কিশোর ঘোষ:
ভারতীয় ফুটবলের বর্তমান বলে কিছু নেই, সবটাই অতীত। এই ভাবনাটাকেই বেমালুম নাড়িয়ে দিল গুরপ্রীত সিংহ সান্ধু, সন্দেশ ঝিঙ্গন, আদিল খান, উদান্তা সিংহরা। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে দুম করে কাতারের মতো চলতি বছরের এশিয়ান চাম্পিয়ানকে রুখে দিল তাঁরা। হয়তো জেতেনি কিন্তু দোহার মাঠে একটা অ্যাওয়ে ম্যাচে জিতে জেতে পারত টাইপ খেলাই দেখলাম আমরা। শেষের দিকে উদান্তা সিংহের ওই বাঁক খাওয়ানো ভলিটা যদি…! অনেকে বলবেন, একটা ড্র ম্যাচকে নিয়ে এত কথা কীসের! তাদের জন্য পাল্টা প্রশ্ন, হতেও পারে ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে প্রাক্তন ফুটবলাররা আদিখ্যেতা করছে, অতিরিক্ত আবেগে ভাসছে, কিন্তু গোটা এশিয়া তথা ফুটবল বিশ্বও কেন কাতার ও ভারতের গতকালকের খেলাটাকে নিয়ে এত শব্দ খরচ করছে? সকলেই নিশ্চয়ই মুর্খ নয়। অর্থাৎ, কিছু কারণ বোধ হয় রয়েছে। সেই গভীর কারণ ভারতীয় ফুটবলের জন্য হয়তো খুব প্রশংসনীয় নয়।
আসলে দুটি দেশের ফুটবল মান, ফিফা র্যাঙ্কিং তথা সাম্প্রতিক পারফরম্যন্স দেখলে গতকালকের খেলাটিকে ভোজবাজি বলেই মনে হয়। একটি দল এশিয়ার সেরা, ফিফা র্যাঙ্কিং ৬৭, অন্যটি নামতে নামতে এই মহাদেশের প্রথম কুরিটি দলের মধ্যে কোনও মতে টিকে রয়েছে। ফিফা র্যাঙ্কিং ১০৪। একটা দল কদিন আগে কোপা আমেরিকা খেল এল। আরেকটা দলের থেকে কোপা আমেরিকার দূরত্ব পৃথিবী আর প্লুটোর সমান বা বেশি। ওই যে বলছিলাম, ভারতীয় ফুটবলের বর্তমান বলে কিছু নেই, সবটাই অতীত।
সে সব শুনতে শুনতেই তো বড় হয়েছি, ফুটবলে নাকি আমরা একসময় এশিয়ার অন্যতম সুপার পাওয়ার ছিলাম! শৈলেন মান্না, পিকে-চুনি-বলরামরা যখন এদেশের ফুটবল তারকা তখন নাকি আমরাও চিন-জাপান-কোরিয়া-ইরান-ইরাকদের সমান সমান! এশিয়ান গেমসের রেজাল্টও সেই সাক্ষ্য দেয়। এমনকী তার আগে আমরা নাকি পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা-ভাগ্যে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু খেলিনি। কারণ, তখনও এদেশের ফুটবলাররা খেলে খালি পায়ে, ওদিকে বাকি বিশ্ব ততদিনে স্পাইকওলা ফুটবলারস শু পড়ে খেলছে দিব্য। পরের দিকে অর্থাৎ গত শতাব্দীর সাতের দশক কী আটের দশকের ভারতীয় ফুটবল নিয়েও ভালো ভালো কথাই শুনেছি বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে। অতীতচারীতা যেমন হয় আর কী—আমাদের সময় না সব ভালো ছিল। মানুষ-গাছ-পাখি-পুলিশ-ডাকাত…! ডাকাত ভালো ছিল কোন থিওরিতে গুরুজন বলে সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে ফুটবল নিয়ে তাদের যুক্তি পরের প্রজন্মের আমরা মেনে নিতে বাধ্য ছিলাম। কারণ, সময়সময়ে ভারতীয় ফুটবলের কুৎসিত দশা। নামতে নামতে কোথায় নেমেছি—বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কারা পর্যন্ত বলে বলে হারায়। এদিকে ফেডারেশনের বচ্ছরকার কাজ–বিদেশ থেকে কঠিন উচ্চারণের নামের বিদেশি কোচ ধরে আনা। তারপর সাংবাদিক সম্মেলনে ভারত ঘুমন্ত দৈত্যটৈত্য ধরনের ঢপ দিয়ে একগুচ্ছ টাকা কামিয়ে পগাড়পার সাহেবের বাচ্চারা! দিনের শেষে দেখা গেল আমরা সেই সাফ কাপ চাম্পিয়ান ভারত। যাদের ঘুম এক হাজার বছরে পড়েও ভাঙবে বলেও বিশ্বাস হয় না।
তবুও, আমরা যারা ভারতীয় ফুটবলকে কেন যেন ভালোবাসি, এখনও স্বপ্ন দেখি! মনে মনে বলি, আমাদের কৃশানু ছিল, এই তো ভাইচুং, ওই তো আইএম বিজয়ন, এই যে সুনীল ছেত্রী, আহা সুব্রত পালের মতো একটা কিপার! এই তো পরম্পরা। এই আমরা যেন আশায় বাঁচে চাষা টাইপ পাবলিক। তবে এসব কথা মুখে আনি না। কারণ বাড়ি-অফিস-স্কুল-কলেজ-রাস্তাঘাটে রোনাল্ড-মেসির সাপোর্টার ভর্তি। হ্যাঁ, ভারতীয় নাগরিকই, কিন্তু আইলিগ নিয়ে কথা বলতে এদের আত্মসম্মানে বাঁধে, এরা কথা বলে ইপিএল-বুন্দেশ লিগা-সিরিয়াআ কমপক্ষে জে-লিগের ভাষায়। সেখানে আইলিগ বা আইএসএল নিয়ে কথা তুলতে গেলে গালাগাল খেতে হয়। হয়তো সত্যিই, এই ভারতীয় ফুটবল নিয়ে কথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ না, কিন্তু, তবুও বোকা বোকা দেশপ্রেমই হবে বোধ হয়! অতএব, হেরে যাওয়ার চান্স নব্বই শতাংশ জেনেও মঙ্গলবারের ভারত ভার্সেস কাতার ম্যাচটা দেখতে বসেছিলাম টিভি খুলে।
আর চোখের সামনে হাফটাইম হয়ে গেল, গোল দিতে পারল না কাতার! অবাক হয়ে দেখছিলাম সাম্প্রতিক অতীতের ভারতীয় দলগুলোর মতো বড় দলের আক্রমণে ঘাবড়াচ্ছিল না সন্দেশ ঝিঙ্গনদের ডিফেন্স। নিচ থেকে নিখুঁত পাশ খেলে উঠে আসছিল মাঝেমাঝেই। উইঙ ধরে উদান্তা ছুট দিচ্ছিল হরিণের মতো, মাঝেমাঝেই। এভাবেই নব্বই মিনিট কেটে গেল, হাজার চেষ্টা করেও গোলের মুখ খুলতে পারল না কাতার! এদিকে গুরপ্রীতের কাঁধে যেন দুর্গাঠাকুরের দশ হাত লেগে গেছে! যা আসছে রুখে দিচ্ছে অনায়াশে। খেলা শেষের বাঁশি বাজালেন রেফারি। কাতারের সঙ্গে ড্র করল ভারত, জিতে গেল ভারতীয় ফুটবল!
আসলে জিতলাম আমরা। আমরা গুটিকয় ভারতীয় ফুটবলের ভক্ত দর্শক। এখন কটা দিন অন্তত কলার উঁচু করে ঘুরতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা, আপাতত অতীত নিয়ে জ্ঞান দিতে আসবে না বয়োজ্যেষ্ঠ ‘সব ভালো’ পার্টিরা। কারণ সুনীল ছেত্রী, গুরপ্রিত সিংহ সান্ধুদের ভারত যা করেছে, তা দুশো শতাংশ খাটি বর্তমান। জয় ভারতীয় ফুটবল। ঘুমন্ত দৈত্যের ঘুম ভাঙুক সত্যি সত্যি।