চিরজিৎ পাল :
জ্ঞানীগুণী মানুষেরা, বিশেষত রাজনীতিবিদরা বাজেট বুঝতে সময় নেন বড়োজোর ১৫মিনিট। চাকুরীজীবি
মধ্যবিত্তের সময় লাগে বড়োজর ১ঘন্টা। এবছর বাজেট-টা ঠিক মতন অনুসরণ করতে পারিনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায়, তাই পয়লা ফেব্রুয়ারী দুপুরের পর থেকে যখন ফেসবুকে একের পর এক হতাশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, ভাবলাম একটু দেখি সমস্যাটা কোথায়।
আমার বন্ধুদের সবচেয়ে বেশি যেটা আঘাত করেছে সেটা আয়করে কোনও ছাড় না পাওয়ার ব্যাপারটা। রাগের পরিমাণ এতটাই যেন এনডিএ শাসনের আগে কোনোদিন আয়কর দিতেই হত না। এরাই এসে চালু করল। তাই আয়কর কমানো বা একেবারে বন্ধ করে দেওয়াটা এদের আশু কর্তব্য ছিল, যা না করে জেটলি ক্ষমাহীন অপরাধ করেছেন। একজন তো বলেই ফেলল , “নোটবন্দির সময় এত যে এটিএমের লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম, তার কোনও পুরস্কার নেই?” শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ড ইনভেস্টমেন্টের ওপর লংটার্ম ক্যাপিটাল গেইন লাগিয়ে মধ্যবিত্তের কোমর ভেঙে দেওয়ার উপক্রম করেছেন বলেও কারও মত।
কাস্টমস ডিউটি বেড়ে যাওয়াতেও অনেকেই ক্ষুব্ধ, ভাবটা এমন যেন সকালে গিন্নিকে বলে বেরিয়েছিলেন যে ফেরার সময় একটা মার্সিডিস নিয়েই ফিরব। একটু বড় বৃত্তে যে এঁরা ভাবেননি তা নয়। বাজেটে যে কর্মসংস্থানের কোনও দিশা নেই সেটাও বোঝা হয়ে গিয়েছে। শিল্পকে চাঙ্গা করার কোনও ব্যবস্থা নেই। এবং আর্থিক ঘাটতি টার্গেট ছুঁতে না পারার কারনে গোটা অর্থ ব্যবস্থাকে মোটামুটিভাবে রসাতলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে সবচেয়ে মজার মন্তব্যএসেছে ন্যাশনাল ব্যাম্বু মিশন নিয়ে। জেটলি যে বাঁশের চাষ করতে বিশেষ আগ্রহী সেটা চিন্তার কারন তো বটেই তবে আমি বাঁশের আলোচনায় আসব সব শেষে। তার আগে একবার দেখে নেব বাজেটে সত্যি কি আছে।
এটা ঠিক যে চাকুরিজীবীদের জন্যে সত্যিই কিছু নেই। আয়করে যে ছাড় বেড়েছে সেটা অন্যকিছু অ্যালাউন্স কমে যাওয়ায় এবং সেস ১শতাংশ বেড়ে যাওয়ার ফলে কয়েকশো টাকার বেশি সুবিধে দেবে না। কিছু পেপারওয়ার্ক নিশ্চই কমবে, কিন্তু আর্থিক লাভ খুব সামান্যই।
লংটার্ম ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স কর্পোরেট হাউস এবং ফিনান্সিয়াল ইনভেস্টারদের বেশি সমস্যায় ফেলবে,সাধারন ইনভেস্টরদের নয়। যে সাধারন ইনভেস্ট বছরে ১লক্ষ টাকার বেশি লাভ করতে পারে এক বছরের বেশি শেয়ার হোল্ড করে,তার ১০% ট্যাক্স দিতে কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। বিশেষ করে সেনসেক্স যেভাবে হু হু করে বাড়ছে, তাতে তার লাভও জবরদস্ত হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।
এনডিএ জমানায় একটা অভিযোগ বারবার উঠেছে যে বয়স্ক নাগরিকরা কোনও সুবিধা পাচ্ছেন না। বরং উত্তর সুদ কমে যাওয়ার ফলে তাঁরা খুব মুশকিলে পড়েছেন। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয় তার কারন সুদ এবং মূল্যবৃদ্ধি একে ওপরের সঙ্গে যুক্ত দুটো বিষয়। মোদি সরকারের আমলে মূল্যবৃদ্ধি যথেষ্টই লাগামের মধ্যে আছে, তাই সুদ কমাটাই স্বাভাবিক। তাসত্ত্বেও এই বাজেট প্রবীণ নাগরিকদের বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। সুদ থেকে আয়ের ওপর ট্যাক্স-এ ছাড় ১০হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০হাজার করা ছাড়াও স্বাস্থ্য বিমার (৮০ডি, ৮০ডিডিবি) ওপর কর ছাড় বাড়ানো হয়েছে।
এবারই বাজেটে প্রথম কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান নিয়ে সরাসরি আলোচনা করা হয়েছে। সরকারি পরিকাঠামো এবং সামাজিক প্রকল্পে বছরে ৫লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে অনুমান করা হয়েছে (যা প্রতিবছর কাজের জগতে প্রবেশ করা মানুষের সংখ্যার ৫০%)। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় মুদ্রা যোজনায় আরও ৩লক্ষ কোটি টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত এই প্রকল্প স্বনিযুক্তি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল বলেই খবর।
সরকারের বিরুদ্ধে আর একটা বড় অভিযোগ ছিল যে নোটবন্দির পরে ক্ষুদ্রশিল্পে যে মূল ধন সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা কাটানোর কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। এই বাজেটে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসার ক্ষেত্রের পরিধি ৫০কোটি থেকে বাড়িয়ে ২৫০কোটি টার্নওভার করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এসব ব্যবসা ২৫% ট্যাক্স-এর সুবিধে পাবে।
চীনের ডাম্পিং পলিসির শিকার বহু দেশ। আমাদের শিল্পপতিদের দাবি ছিল এর একটা সুরাহার ব্যবস্থা করা হোক। টিভি প্যানেলে, মোবাইল ফোনে, বিদেশী গাড়িতে কাস্টমস ডিউটি ৫% বাড়ানো হয়েছে কিছুটা এই কারনেই। এর ফলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প আরও উৎসাহিত হবে বলেই অনুমান।
পেট্রল-ডিজেলের ওপর একসাইজ ডিউটি ২টাকা কমানো হয়েছে। অতিরিক্ত একসাইজ ডিউটি তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন রোড সেস লাগু হওয়ার ফলে দামে কোনো তারতম্য হবে না।
বিরোধীদের আরোপিত দলিত-বিরোধী অপবাদ ঘোচাতে এসসিএসটি স্কিমে ৯৫হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে যা গতবারের তুলনায় ১২% বেশি।
বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে মানোন্নয়নের জন্য একলব্য মডেল স্কুলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তফসিলি উপজাতির শিশুরা যাতে নিজেদের পরিবেশে সঠিক মানের শিক্ষা পায় এই স্কিম সেটা দেখবে। শিক্ষালয়ে গবেষণার পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাতে রাইজ নামের স্কিম করা হয়েছে। তার জন্যে যথেষ্ট ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে।
সবথেকে বড় বিপ্লব ঘটানো হয়েছে গ্রামীণ ক্ষেত্রে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ন্যুনতম সাহায্য মূল্যে যাতে ফসল ফলানোর খরচের কম করে দেড় গুন হয় সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে চাষ করে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার মতন পরিস্থিতি রোধ হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। চাষিদের আত্মহত্যাও রোধ করা যাবে বলে অনুমান।
এছাড়াও ১০কোটি পরিবারকে (৫০কোটি মানুষ) ৫লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা পৃথীবীতে এধরনের যে কোনো প্রকল্পের থেকে বড়। আমেরিকার ‘ওবামা কেয়ারে’র অনুকরণে এটাকে ‘মোদিকেয়ার’ বলা শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের ফলে গরিব মানুষের একটা বড় মাথাব্যথা চিরকালের মতন দূর হবে, যা একটা অত্যন্ত জরুরি এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নরেগা’র পরে এতোবড় সামাজিক প্রকল্প আর হাতে নেওয়া হয়নি। জীবনদায়ী ওষুধ, স্টেন্ট ইত্যাদির দাম বেঁধে দেওয়া দিয়ে যে যাত্রা মোদী শুরু করেছিল, এই প্রকল্প তাকে সম্পূর্ণতা দেবে।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্যে আরো একগুচ্ছ প্রকল্প আছে যার আলোচনায় আর ঢুকব না, শুধু বলব যে গ্রামীণ আয় বাড়লে শিল্পে চাহিদা বাড়বে, যার ফলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট বাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে, এবং শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে। যে চাকাটা এতদিন কিছুটা মন্থর ছিল সেটা দ্রুত ঘুরবে বলে মনে করছে শিল্পমহল।
সবশেষে আসি বাঁশের কথায়। উত্তরপূর্ব ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল-কে গ্রীন গোল্ড আখ্যা দিয়ে তার জন্যে প্রায় ১৩০০কোটি টাকা ধার্য করেছেন জেটলি মহাশয়, যেটা নিয়ে প্রচুর হাসি-ঠাট্টা হচ্ছে। আসলে উত্তরপূর্ব ভারতের যে কোনো বিষয় নিয়ে বিদ্রুপ করাটা আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যেস।ওই অঞ্চল নিয়ে মোদী যে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন সেটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারন হওয়াটা বিচিত্র নয়।
তবেএটা ঠিক যে চাকুরিজীবীদের হাতে রইল পেন্সিল, ঠিক প্রতিবারের মতোই।
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan