Breaking News
Home / TRENDING / নীলগিরির নীলমাধবই পুরীর জগন্নাথ

নীলগিরির নীলমাধবই পুরীর জগন্নাথ

 

কমলেন্দু সরকার   :

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজদরবারে এলেন এক যৌবন অতিক্রান্ত এক বৈষ্ণব। পরনে সামান্য পোশাক। অপূর্ব তাঁর কণ্ঠস্বর! ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজকার্য শেষ করে তাঁকে বললেন, “আপনার পরিচয় জানতে পারি কী?” বৈষ্ণব বললেন, “আমার পরিচয় তেমন কিছু নয়। কিন্তু আপনি যাঁর জন্য ব্যাকুল তাঁর খবর আমি এনেছি।”
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাবলেন, এই বৈষ্ণব কী অন্তর্যামী! কিন্তু রাজা বললেন, “আপনি যদি আমি কার জন্য অধীর। বলুন-না, তাঁর সন্ধান কোথায় পাব?”
বৈষ্ণবের মুখে স্মিত হাসি। বললেন, “তোমাকেই খুঁজে পেতে হবে। তবে, তোমার আরাধ্য বিষ্ণু নীলমাধব রূপেই কোথাও রয়েছেন এই মর্তেই।” এই বলে মুহূর্তেই বিদায় নিলেন তিনি।
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রাহ্মণদের ডেকে নীলমাধবের সন্ধানে পাঠালেন সকলকে। ব্রাহ্মণেরা ফিরে এলেন কোনও সংবাদ না নিয়েই। ব্যতিক্রম বিদ্যাপতি। তার অপেক্ষায় রইলেন রাজা। ওদিকে বিদ্যাপতি হাঁটতে হাঁটতে হাজির নীলগিরি পাহাড়ের কোলে। চারিদিকে শুধুই অরণ্য। মানুষের দেখা নেই। তবুও হাল ছাড়েননি ক্লান্ত বিদ্যাপতি। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখলেন সার দেওয়া সব কুটির। এক কুটির সামনে দেখলেন এক সুন্দরী যুবতী। বিদ্যাপতি যুবতীকে বললেন, “আমি ব্রাহ্মণ। আমি সাহায্যপ্রার্থী।”
যুবতী বললেন, “প্রণাম নেবেন হে ব্রাহ্মণ। আমি শবররাজ বিশ্বাবসু কন্যা ললিতা। অতিথি সেবা আমার কর্তব্য।”
বিদ্যাপতি আশ্রয় পেলেন শবররাজ গৃহে। কেটেও গেল বহুদিন। নীলমাধবের খোঁজ আর মেলে না। বিদ্যাপতি লক্ষ করেন রোজ রাত্রি বেলা শবররাজ গৃহ ত্যাগ করেন। ফেরেন পরের দিন মধ্যাহ্নে। তাঁর কৌতূহল বাড়ে। শবররাজ যান জঙ্গলের উদ্দেশে। পরনে পরিষ্কার বস্ত্র। বিদ্যাপতির সন্দেহ হয়। ভাবেন নীলমাধবের পুজো করতে যান না তো তিনি! একদিন শবররাজের পিছু নেওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ঘরের বাইরে বেরোতেই ধরা পড়ে গেলেন ললিতার কাছে। ললিতা বললেন, “হে ব্রাহ্মণ, আপনার অনিদ্রার কারণ জানতে পারি?”
বিদ্যাপতি কিছু না-ভেবেই বললেন, “তুমিই আমার অনিদ্রার কারণ।”
রক্তিম হয়ে ওঠে ললিতার মুখমণ্ডল। এই দিন দু’জনের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। বিদ্যাপতির একটাই ভাবনা যে করেই হোক নীলমাধবের খোঁজ চাই। রাজার আদেশ।
এতদিনে বিদ্যাপতি শবররাজের হাবভাবে বুঝতে পেরেছেন তিনিই জানেন নীলমাধবের সন্ধান। ললিতার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেন বিদ্যাপতি। একদিন শবররাজের সম্মতিতেই বিবাহ সম্পন্ন হল বিদ্যাপতি-ললিতার। একদিন রাতে আলিঙ্গনাবদ্ধ ললিতাকে বললেন বিদ্যাপতি, “আমি এখানে এসেছি মালব্যদেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আদেশে। উদ্দেশ্য নীলমাধবের খোঁজ নেওয়া।”
কেঁপে উঠলেন ললিতা। বিদ্যাপতির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। ওদিকে বাবার ধ্যানজ্ঞান নীলমাধব-ই। আবার স্বামী বিদ্যাপতি নীলমাধবের দর্শন এবং খোঁজ চান। দোটানায় পড়লেন ললিতা।
একদিন সাহস করে বিদ্যাপতির ইচ্ছার কথা জানালেন ললিতা। অনেক ভেবেচিন্তে পিতা বিশ্বাবসু বললেন, “ঠিক আছে নিয়ে যাব। তবে, যাওয়ার পথে চোখে বাঁধন থাকবে। নীলমাধব দর্শনের সময় চোখ খুলে দেব। শর্তে রাজি বিদ্যাপতি। একদিন বিদ্যাপতিকে নিয়ে গেলেন শবররাজ। দর্শন করলেন বিদ্যাপতি। চারপাশের বাতাসে সুন্দর গন্ধ। বিদ্যাপতি দেখলেন অপূর্ব আলোর ছটায় অরণ্য আলোকিত। নীলকান্তমণির মতো উজ্জ্বল! প্রণাম করলেন বিদ্যাপতি। নীলমাধবকে পুজো করার সময় শবররাজ শুনতে পেলেন নীলমাধব বলছেন, “এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে তুমিই আমার নিত্যসেবা করে এসেছ। আমি এখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের ভক্তির টানে তার কাছে চললাম।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন শবররাজ বিশ্বাবসু।
ফিরে এসে বন্দি করলেন বিদ্যাপতিকে। বিদ্যাপতির জায়গা হল কারাগারে। কন্যা ললিতার সঙ্গে অনেক বাদানুবাদের পর মুক্তি দিলেন বিদ্যাপতিকে। ফিরলেন বিদ্যাপতি নিজ রাজ্যে। সব ঘটনা জানালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে। সব শুনলেন রাজা। একদিন সেনা নিয়ে রওনা দিলেন শবরপল্লি। সেখানে তৈরি হল যুদ্ধের পরিবেশ। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জানতে চাইলেন শবররাজ বিশ্বাবসুর কাছে “নীলমাধবের মূর্তি কোথায়?”
শবররাজ বললেন, “আমি জানি না।”
এই উত্তর শুনে শবররাজকে মারতে উদ্যত হলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তখন রাজা শুনতে পেলেন, “ক্রোধ সংবরণ করো ইন্দ্রদ্যুম্ন। নীলমাধব রূপ দর্শন তুমি পাবে না। তুমি ফিরে গিয়ে আমার দারুব্রহ্ম মূর্তি প্রতিষ্ঠা করো।”
ইন্দ্রদ্যুম্ন ফিরে এলেন। তিনি বৈশাখ মাসের শুক্লা নবমী তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করলেন। মন্দিরের কাজ শেষ। উদ্বোধন করবে কে! তেমন ব্রাহ্মণ তো নেই রাজ্যে। দেবর্ষি নারদের পরামর্শে গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা অপেক্ষা করতে বললেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বর্গরাজ্যে ব্রহ্মার অপেক্ষায় বসে রইলেন। ওদিকে সমুদ্রের ঝড়ে বালি পড়ে ঢেকে গেল মন্দির।
সুরদেব পুত্র গলমাধব তখন উৎকলের রাজা। তিনি সমুদ্র ধারে এসে দেখেন একটি ঘোড়া আটকে গেছে। বালির মধ্যে থেকে একটা পা কিছুতেই বার করতে পারছে না। গলমাধব বালি সরিয়ে উদ্ধারের পর আবিষ্কার করলেন বালিচাপা সুন্দর এক মন্দির।
ব্রহ্মাকে নিয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন মর্তে ফিরে দেখেন এই অবস্থা। গলমাধবের সঙ্গে বিরোধ বাধল তাঁর। ব্রহ্মা সব শুনে বললেন, “মন্দিরটি বালির মধ্যে থেকে বার করার জন্য গলমাধবের প্রাপ্য আছে। তবে মিথ্যা বলার জন্য ওর নাম সবাই ভুলে যাবে। কেউ মনে রাখবে গলমাধবের কথা।”
ওদিকে স্বপ্নাদেশ মতো দারুব্রহ্ম সমুদ্রে ভেসে আসার কথা। সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, সঙ্গে শবররাজ বিশ্বাবসু। ভেসে এল দারুব্রহ্ম। কিন্তু কেউই বানাতে পারলেন না মূর্তি! এক বৃদ্ধ এলেন। বললেন তাঁর নাম অনন্ত বাসুদেব মহারানা। তিনি বানিয়ে দেবেন মূর্তি। মোট ২১ দিন লাগবে। শর্ত একটাই এই ২১ দিনের মধ্যে কেউ তাঁকে ডাকতে পারবেন না। দরজাও খুলতে পারবেন না। যদি দরজা কেউ খোলেন মূর্তি যতটুকু হবে সেইখানে কাজ শেষ করে চলে যাব। এই বলে অনন্ত বাসুদেব ঢুকে গেলেন ঘরের ভিতর। মাঝেমধ্যে খুটখাট আওয়াজও কানে আসে। সকলেরই কৌতূহল কী করছেন একা একা ঘরের ভিতর! রানি গুন্ডিচা খালি উসখুস করেন। ভাবেন কিছু হয়নি তো সূত্রধরের! ১৪ দিনের মাথায় রানি গুন্ডিচা বললেন, “আমার মনে হয় বৃদ্ধ মূর্তি বানাতে বানাতে মারা গেছেন। উনি মারা গেলে সমস্ত দায় আমাদের ওপর পড়বে।”
রাজা দরজা খুললেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন দেখলেন বৃদ্ধ অনন্ত বাসুদেব একমনে কাজ করছেন। এবার কাজ বন্ধ করে রাজার দিকে তাকালেন। বললেন, “রাজা আপনি শর্ত ভঙ্গ করলেন। আমার শর্তমতো কাজ বন্ধ করলাম। মূর্তি অসমাপ্ত রেখে চললাম।”
মুহূর্তের মধ্যেই উধাও হলেন অনন্ত বাসুদেব মহারানা। তাঁকে কোথাও আর দেখাই গেল না! রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেখলেন সিংহাসনে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলরাম বিরাজিত! ভগবানের তিনটি বিগ্রহ। হাত-পা পুরো হয়নি। আঙুলও নেই হাত-পায়ের। মন্ত্রী বললেন, “রাজামশায়, আমার ধারণা এই সূত্রধরই স্বয়ং জগন্নাথ!”
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গ্লানিতে ভুগতে লাগলেন। ভাবলেন এ আমি কী ভুল করলাম! ভাবলেন, আমার মৃত্যুই শ্রেয়। ভক্তের মনের কথা জানতে পেরে জগন্নাথদেব বললেন, “তুমি আত্মহননের চিন্তা ত্যাগ করো। এ জগতে যা ঘটে তা আমার ইচ্ছাতেই হয়। আমার ইচ্ছা ছাড়া কিছু হওয়ার নয়। এই যে তোমার শর্ত ভঙ্গ, এ আমার ইচ্ছাতেই। আমি এই শ্রীক্ষেত্রে দারুব্রহ্ম মূর্তিতেই শ্রীপুরুষোত্তম নামেই অধিষ্ঠান করব। আমি অপ্রাকৃত হাত দিয়েই ভক্তের সেবা এবং পুজো নেব।”
ভগবানের কথা শুনে শান্ত হলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। হাতজোড় করে জগন্নাথদেবের উদ্দেশে বললেন, “যে-সূত্রধর তোমার এই মূর্তি গড়েছেন তাঁর বংশধরেরা যেন যুগ যুগ ধরে তোমাদের তিনটি রথ তৈরি করে দেন।”
জগন্নাথদেব বললেন, “তাই হবে। যে-শবররাজ আমার নিত্যসেবা দিত তাঁরই বংশধরেরাই হবে আমার সেবক। ওরা দয়িতা নামে পরিচিত হবে। বিদ্যাপতির ব্রাহ্মণ-পত্নির বংশধরেরা হবে আমার পূজক। আর ললিতা অর্থাৎ শবরকন্যার বংশধরেরা হবে পাচক। ওরা ভোগ রান্না করবে।”
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বললেন, “প্রভু আপনার সমস্ত বিধানই আমার কাছে আদেশ। আমারও নিবেদন আছে। আপনার দরজা মাত্র তিনঘণ্টা বন্ধ থাকবে। আর বাকি উন্মুক্ত থাকবে ভক্তদের জন্য। সারাদিন আপনার সেবা এবং ভোজন চলবে।”
জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলরামকে নিয়ে রয়েছে কিংবদন্তি। সুভদ্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে সমুদ্র তাঁকে বিবাহ করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করে। এবং গর্জন করতে করতে এগিয়েও আসে। ভীত সুভদ্রা পালিয়ে আসেন মন্দিরের ভিতর। শ্রীকৃষ্ণ জানতে পেরে সুভদ্রা রেখে দেন জগন্নাথ আর বলরামের মাঝে। সুভদ্রার দূর হল সব ভয়ভীতি। শ্রীকৃষ্ণ এবং জগন্নাথ এগোতেও বারণ করেন সমুদ্রকে। এবং বললেন তোমার গর্জনও যেন না-পৌঁছয় সুভদ্রার কানে। সেই কারণেই সমুদ্র আর এগোয়নি আর গর্জনও সুভদ্রার কানে আসেনি। হনুমানকে রেখে দিলেন পাহারায়। তার কাজ হল সমুদ্রর অগ্রসর রুখে দেওয়া। আজও একই কাজে ব্যস্ত হনুমান। সেইজন্য সিংহদ্বার পেরিয়ে গেলে সমুদ্রগর্জন আর কানে আসে না।

Spread the love

Check Also

নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই

সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …

শুধুমাত্র শুদ্ধিকরন আর বাংলাদেশ নয়, মমতার যে কথায় কান দিল না মেইনস্ট্রিম মিডিয়া

“ভর্সা যেন না পায় কোনও দাঙ্গামুখো হতচ্ছাড়া, সবাই মিলে বেঁচে থাকার ভর্সা তাদের করুক তাড়া’ …

কোন সাহসে দলের প্রধান স্লোগান কে চ্যালেঞ্জ করলেন শুভেন্দু? কপালে ভাঁজ বিজেপির

দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় উফ্! শুভেন্দুর বক্তৃতা শুনে সেই যে গায়ে কাঁটা দিয়েছে সেই কাঁটা আর যায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *