ড. জিষ্ণু বসু :
আরও একটি ২৩ জুন চলে গেল। ১৯৫৩ থেকে আজ পর্যন্ত নিরন্তর চলেছে তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। আজও এই মহামানবের প্রয়াণ দিবসে নবান্ন থেকে কেউ, কোনও একজন কী গিয়েছিলেন শ্মশানে তাঁর মর্মর মূর্তিতে ফুলের মালা দিতে? অথচ এই রাজ্যের অস্তিত্বই থাকত না ওই মানুষটা না থাকলে। কল্লোলিনী কলকাতা ভারতবর্ষে থাকত না। এই শিল্পের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, দিনের শেষে শান্তিতে বাড়ি ফেরা— কিচ্ছু না!
ঠিক কি করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ?
মহম্মদ আলি জিন্না চেয়েছিলেন সমগ্র বাংলাটাই পাকিস্তানে আসুক। সৈয়দ সুরাবর্দ্দি আর শরৎ বসুরা চেয়েছিলেন অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা। দুটো প্রস্তাবই যে সর্বনাশের নামান্তর সেদিন বুঝেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। শ্যামাপ্রসাদ তার আগেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি, সেই গজদন্ত মিনার থেকে নেমে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, মানুষের মন তৈরি করেছেন, প্রবুদ্ধ বিদ্বানদের এক করেছেন এই কলকাতা-সহ বাংলার হিন্দু বহুল অংশকে। ভারতভুক্তির জন্য। একে একে পাশে দাঁড়িয়েছেন ড. মেঘনাথ সাহা, এন সি চৌধুরী, বি সি সিনহা, সুচেতা কৃপালিনী। ১৯৪৭ সালের ৪ মে, শ্যামাপ্রসাদের আন্দোলনে ঘাবড়ে গিয়ে জিন্না দিল্লিতে বললেন, “বাংলাকে ভাগ করার জন্য হিন্দু মহাসভা ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে।… তবে তো আমরা খণ্ডিত পোকায় কাটা পাকিস্তান পাব?” কিন্তু শেষপর্যন্ত জিতে গেলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ওই বছর ২০ জুন বঙ্গীয় বিধানসভা ভেঙে তৈরি হল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ও পূর্ববঙ্গ বিধানসভা।
শ্যামাপ্রসাদ যদি বাংলার এতটুকু জায়গা না রাখতেন তবে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ৬০ দশক থেকে আজ পর্যন্ত যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নিপীড়িত, ধর্ষিত, সর্বস্বান্ত হয়ে ভারতে এসেছেন। তাঁদের সবার ঠিকানা হত হয় ছত্রিশগড়ের মানা ক্যাম্প নয়তো ওডিশার উষর মালকান গিরি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপদ পায়ে ঠেলে উদ্বাস্তু শিবিরে শিবিরে সেবা করেছেন।
স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম সমস্যা কাশ্মীর। যেভাবে হায়দরাবাদের সমস্যা সমাধান হয়েছে তার থেকেও অনেক সহজে সমাধান হত কাশ্মীর সমস্যা। সেদিন পণ্ডিত নেহেরুর খামখেয়ালিপনার প্রতিবাদ করেছিলেন দু’জন সিংহহৃদয় মানুষ। দু’জনকেই নেহেরু যমের মতো ভয় পেতেন। তাঁরা হলেন বাবা সাহেব আম্বেদকর আর শ্যামাপ্রসাদ। একটা দেশে দু’রকম পতাকা, দু’রকম আইন আর দু’জন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারে নাকি? প্রতিবাদে কাশ্মীর সরকারের পারমিট ছাড়াই উপত্যকায় ঢুকেছিলেন। সেদিন শেখ আব্দুল্লার সরকার এই দেশবরেণ্য মানুষটিকে একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে মেরেছিল। আজও যখন রাহুল পণ্ডিতিয়ার লেখা ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’ পড়ি যখন কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত পণ্ডিত ডোগরাদের ভয়াবহ নির্যাতনে চোখ জলে ভরে ওঠে, কিংবা পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও গ্রামে কশ্মীরের জঙ্গিদের হাতে নিহত কোনও সৈন্যের কফিনবন্দি দেহ আসে, এখনও যেন মনে হয় কাশ্মীরের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে সঙ্গী তরুণ সাংবাদিক অটলবিহারী বাজপেয়ীকে বলা তাঁর শেষ কথা, “বাজপেয়ী তুমি ফিরে যাও। আর দেশবাসীকে বলো আমি কাশ্মীরে ঢুকে গেছি— কিন্তু পারমিট করিনি!”
শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু আজও রহস্য। সেদিনও বাংলার মানুষ প্রতিবাদে মহানগরের রাস্তা জনপ্লাবিত করে দিয়েছিল। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে শ্যামাপ্রসাদের মৃতদেহ মধ্যরাত্রে কলকাতা বিমানবন্দরে আনা হল। তখন বিমানবন্দরে মানুষের সমুদ্র। সেদিন কংগ্রেস প্রমাদ গুনেছিল। এই হত্যা, এই অপরাধের বিচার চাইবে না বাংলার মানুষ? সেদিন কংগ্রেসের পরিত্রাতা হয়ে যেন এগিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। একটি মাত্র কৌশলে মানুষের দৃষ্টি এই জঘন্য অপরাধের থেকে একেবারে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন শ্যামাপ্রসাদ চলে গেলেন। তার ঠিক সাতদিন পর থেকে শুরু হল পরিকল্পনা ‘ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানি’ নামে ইংরেজ বাণিজ্যিক সংস্থা। কলকাতায় এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির জন্য একের-পর-এক ট্রাম পোড়াতে থাকল সিপিআই, এস ইউ সি আর আর এস পি-সহ বাম দলেরা। কংগ্রেস সরকার গ্রেফতার করে রাজকীয় মর্যাদায় রাখল জ্যোতি বসু, সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়দের। এর প্রতিবাদে বামেরা ৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট ডাকল। শ্যামাপ্রাসাদের মৃত্যু তখনও একপক্ষকালও অতিক্রম করেনি।
মানুষের মন থেকে শ্যামাপ্রসাদের স্মৃতি মুছে দেওয়ার এটাই ছিল প্রধান ধাপ। তাই এর পরে যতদিন রাজ্যে কংগ্রেস সরকার ছিল, তারপর দীর্ঘ বাম জমানায় একটু একটু করে পাঠ্যপুস্তক থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিভিন্ন সংস্থার নামের থেকে পরিকল্পিত ভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদকে। অথচ আজ শ্যামাপ্রসাদের ভাবনা এ রাজ্যে ভীষণ প্রয়োজন। কালিয়াচকের ঘটনা, খাগড়াগড়ের ঘটনা সিমুলিয়ার মতো মাদ্রাসা বার বার মনে করাচ্ছে যে, আজ শ্যামাপ্রসাদের মতো, কাজী নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক অথচ নির্ভীক সত্যবাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব আজ ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামাপ্রসাদকে ১৯৪২ সালের ১৭ জুলাই লিখেছিলেন, “আমি জানি, আমরাই এই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করব— সেদিন আপনাকে ও সুভাষ বসুকেই সকলের আগে মনে পড়বে। আপনারাই হবেন এদেশের সত্যকার নায়ক।” পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই প্রায়শ্চিত্ত কবে করবেন?
(মতামত লেখকের)
লাইক ও শেয়ার করুণ