দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়:
আইকারাসের কথা মনে পড়ে? গ্রীক পুরাণের আইকারাস? ইংরেজ কবিদের রোমান্টিকতা আইকারাস? ছোটদের চোখ গোল গোল করে শোনার মত গল্প আইকারাস?
ছোকরা সূর্যে যাবে বলে ডানা তৈরি করেছিল। সূর্যের দিকে উড়ে যাবে বলে মোমের ডানা! সেই ডানা মেলে সে উড়েও যায় একদিন। সূর্যের দিকে উড়ে যায়। অল্প যেতেই যা হওয়ার তাই হয়। ডানা যায় পুড়ে, মোম যায় গলে। আইকারাস পড়তে থাকে নীচে। আকাশযাত্রী, সূর্যযাত্রী আইকারাস ভূপাতিত হয়। কেউ ফিরেও দেখে না। কৃষকেরা মাঠে চাষ করে,তারা ফিরেও চায় না। যেন কিছুই হয় নি। বা এরকমই তো হওয়ার ছিল। আইকারাস ব্যর্থ হয়। নিঃশব্দ, অনাড়ম্বর ব্যর্থ হওয়া।
বিমল গুরুঙ্গের গায়ের রং ফর্সা, বাড়ির লনে টেনিস খেলে, বড়লোকি জীবন কাটায় বলে সম্ভবত তাঁর জন্যে কেউ গান লেখার কথা ভাবেন নি। সেদিক থেকে দেখলে ছত্রধর জেলে পচলেও তাঁর কপাল তুলনামূলক ভাল! এই সময়ের প্রধান নাগরিক কবিয়াল তাঁর জন্য গান বেঁধেছেন। রুক্ষ মাটির দুঃখ নিয়ে ছত্রধরই দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের দুঃখ, পাহাড়ের শতবর্ষের দাবি, লড়াই, চাহিদা… গুজরাতিদের জন্যে গুজরাত আছে, ওড়িয়াদের জন্যে ওড়িশা, গোর্খাদের জন্যেও একটি রাজ্য থাক, হোক না ছোট। গোর্খা বলতে অবশ্য শুধু গোর্খাই নয়। সবকটি অবাঙালি পাহাড়ি উপজাতি। ভাষায়, চেহারায়, সংস্কৃতিতে ভিন্ন হয়েও নিজেদের জন্যে একটি ভূখণ্ড পেল না ওরা। বাঙালির ঘরে আশ্রিতের মতো রয়ে গেল, থেকে যেতে হল খুদে চোখ আর চ্যাপ্টা ঠোঁটগুলোকে। অনেকদিন আগে সুমন নয় তবে অঞ্জন দত্ত একবার মুখ খুলেছিলেন ওঁদের হয়ে। তবে ওই পর্যন্তই। অনেকদিন হল তিনি তাঁর বেলা বোসের মতোই চুপ করে গেছেন।
সুপ্রীম কোর্ট তাঁকে বিমুখ করেছে। চারিদিকে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠেছে। বিমলের হার হল, মমতার জিত। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তড়িঘড়ি হাত ধুয়ে নিয়েছেন পুরো বিষয়টি থেকে। চামলিং-মমতার হাসিমুখ ছবি কাগজে কাগজে। পাহাড়ে নাকি শিল্প হবে। পাহাড়ে চাই শান্তির গ্যারান্টি। শান্তি এলেই বিনিয়োগ! বনধ বন্ধ হলেই বিনিয়োগ! গুরুঙ্গের ৫ বছর জিটিএ কালে তো শান্তি ছিল। বনধ ছিল না। তবে তখন শিল্পের প্রসার হল না কেন? বিনিয়োগ এল না কেন? উল্টে তখন বাঙালির পার্টি তৃণমূলের প্রসারে, বিস্তারে মন দেওয়া হল বেশি, কেন? এই প্রশ্ন করতে নেই। তাহলেই বহু এজেন্ট, বহু ফোরাম, বহু মহল প্রশ্নকর্তাকে বাঙালি বিদ্বেষী বানিয়ে ছেড়ে দেবে। বাংলা বিরোধী তকমা সেঁটে দেবে তৎক্ষনাত।
হল্লার মধ্যেই বিমল গলা তুলেছেন। বলেছেন, পাহাড়ের মানুষ তার সঙ্গেই আছে। এখন যাঁরা কর্তা হয়েছেন পাহাড়ে তাঁরা পুলিশ দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছেন মানুষকে।
বিমল গুরুঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে সুখে জীবন কাটাতে পারতেন। কাটান নি। পাহাড়ের মানুষ এখনও তাঁর নামে স্লোগান দিতে গিয়ে কাঁদে। গুরুঙ্গ অসম লড়াইতে নেমেছেন। রাজ্য সরকার, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন… সব ভারী ভারী শব্দ। তার ওপর বাঙালি বাঙালি যে পাহাড় ভালোবাসে। মাছ, মুরগী, পাঁঠা ও রসগোল্লা, রাবড়ি, লুচি, কচুরি, সিঙাড়া এবং পাহাড় ভালোবাসে। এমন ভালোবাসা…!
অসম লড়াইতে গুরুঙ্গ আপাতত বেশ অস্বস্তিতে। তবু গলা তুলেছেন।
আইকারাস সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে… তার ডানা পুড়ে যাচ্ছে…
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan