Home / TRENDING / দার্জিলিং, মাতৃভাষা ও মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষণরেখা

দার্জিলিং, মাতৃভাষা ও মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষণরেখা

দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়  :

দার্জিলিঙে সাম্প্রতিক অশান্তি নিয়ে কথা  বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রামায়ণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। রাম নয়, রামের অনুজ লক্ষণের একটি কাহিনি তিনি শুনিয়েছেন সাংবাদিকদের। কাহিনিটি সবার জানা। সীতা যখন সোনার হরিণ চায় বলে বায়না জুড়েছিলেন তখন রাম তো চলে গেলেন সোনার হরিণের খোঁজে লক্ষণকে তাঁর বউদির পাহারায় রেখে। কিছুক্ষণ পরেই স্বর্ণ মৃগয়ারূপী মারীচ রামের কণ্ঠস্বর নকল করে আর্তনাদ করে ওঠে। সেই শব্দে আতঙ্কিত হয়ে সীতা লক্ষণকে যেতে বলেন রামকে রক্ষা করতে। আপত্তি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত লক্ষণকে যেতেই হল রামের সন্ধানে। যাওয়ার সময় লক্ষণ কুটিরের চারপাশে একটি গণ্ডি কেটে দিয়ে যান। এই গণ্ডি পেরলেই সীতার সমূহ বিপদ।

মহাকবি বাল্মীকি এভাবেই এই অখ্যানের উপস্থাপনা করেছেন। পরবর্তীতে ‘লক্ষণের গণ্ডি’ প্রবাদবাক্য হয়েই রয়েছে।

ধান ভানতে শিবের গীত কিংবা ভুত তাড়াতে রাম নামের মতো এই রচনায় এই লক্ষণগণ্ডির অবতারণা।

গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুঙ্গ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সবকিছুর একটা ‘লক্ষণ গণ্ডি’ থাকা ভাল। তাঁর সামগ্রিক বক্তব্য থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গুরুঙ্গ ও তাঁর অনুচরদের সাম্প্রতিক ভূমিকায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও  বিরক্ত। একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, গুরুঙ্গরা মুখ্যমন্ত্রীর নির্ধারিত করা সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্ধারিত সীমানাটা ঠিক কী, তা এই রচনায় আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক, জমজমাট দার্জিলিঙে হঠাৎ করে এই অশান্তির কুয়াশা কেন!

মুখ্যমন্ত্রীর বার বার পাহাড়ে যাওয়া, পাহাড়ে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়াও মুখ্যমন্ত্রীর স্বভাবজাত ক্যারিশমা, তাঁর আন্তরিক ব্যবহার ও কথোপকথন পাহাড়বাসীকে অনেকটাই তাঁর দিকে আকৃষ্ট করেছিল। সাম্প্রতিক পুর নির্বাচনের ফলাফলে কিছুটা হলেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সব মিলিয়ে বেশ চলছিল। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী এমন একটি ঘোষণা করলেন যা কিনা গুরুঙ্গের পায়ে একটি ভুল পাশ বাড়িয়ে দেওয়ার শামিল। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা গুরুঙ্গদের হাতে একটি সহজ ক্যাচের মতো নেমে এল। এবং তা কোনওভাবেই মিস করলেন না গুরুঙ্গ-রোশনারা। বাধ্যতামূলক বাংলা শিক্ষা থেকে ঐচ্ছিক বাংলা শিক্ষায় সরে যেতে মুখ্যমন্ত্রী বেশি সময় নেননি। তাঁর পরিণত রাজনৈতিক বুদ্ধি ও প্রশাসনিক দক্ষতা তাঁকে দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ততক্ষণে গুরুঙ্গ বল ধরে মাঠে খেলতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, মুখ্যমন্ত্রী কেন এমন সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন! কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে হিন্দি পঠনপাঠন বাধ্যতামূলক করেছে। নবান্নের এই সিদ্ধান্ত কী কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের পালটা! এই প্রশ্ন উঠছে। কারণ, মোদীর স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনের পরে পরেই মমতার ছবি সম্বলিত ‘পরিছন্ন বাংলা গড়ি’ বিজ্ঞাপন মানুষ দেখেছেন। সারদা-নারদা প্রভৃতি কাণ্ডে কেন্দ্রীয় বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক চাপ এলে সেই চাপ যে আসলে ‘বাংলা’র প্রতি আক্রমণ কিংবা ‘বাংলা’র সম্মানহানি— এটাই বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে মমতা তথা তৃণমূলের তরফে। জয় বাংলা বা জয়তু বাংলা জাতীয় শ্লোগান কিছুদিন যাবৎ জনপ্রিয় হয়েছে তৃণমূলপন্থীদের মধ্যে। কার্যত হিন্দি যেহেতু দেশের রাষ্ট্রভাষা তাই কারওর অপছন্দ হলেও এব্যাপারে এখন আর তেমন কিছু করার নেই। সুতরাং সারাদেশের যখন কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি বাধ্যতামূলক করছে তখন রাজ্যে বাংলা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের মধ্যেই গলদ রয়ে যায়। এবং এই ত্রুটির রাজনৈতিক ফায়দা যে একটি রাজনৈতিক দল ওঠাতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।

সমতলের বাঙালিরা পাহাড়ের রূপ ও লাবণ্যের যতটা রসিক সেখানকার অধিবাসীদের ভাষার প্রতি আবেগের ততটা সমঝদার কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। বাঙালিদের ভ্রমণপিপাসু মন পাহাড়িদের রুজিরোজগার বলে তাঁদের ওপর নিজেদের আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষিত বাঙালিদের কতটা মানায় সেটাও প্রশ্নাতীত নয়।

গুরুঙ্গের কোনও বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া মুখ্যমন্ত্রীর থেকে জানতে চেয়েছিলেন কোনও সাংবাদিক। উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর দলের কোনও ব্লক নেতা দেবে। মুখ্যমন্ত্রী এহেন উওরের শুরু বেশ কয়েক বছর আগে। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ১৯টি আসনে জয়লাভের পর থেকে। প্রথমে লক্ষণ শেঠ পরে গৌতম দেব এবং এখন বিমল গুরুঙ্গ। গুরুঙ্গ যতক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ের সম্মতিতে গঠিত হওয়া জিটিএ-র সর্বেসর্বা ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর প্রতি পাহাড়প্রেমী মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্য সমীচীন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

গুরঙ্গ যখন রাজ্যের রাজনীতিতে মাথা তুলতে শুরু করেন তখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। পরে মধুর আর এখন দৃশ্যতই তিক্ত। রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের যে-প্রভাবপ্রতিপত্তি তাতে কোনও ছোট দল বা ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কাটা সহজসাধ্য নয়। গুরুঙ্গকে গুন্ডা বলে দেগে দেওয়া সহজ হলেও তিনি যেভাবে সরকারের সঙ্গে আপোশে না-গিয়ে, সুখের রাস্তা না-বেছে যেভাবে অসম লড়াইতে নেমেছেন তা কিন্তু ভাবাচ্ছে বিভিন্ন মহলকে।

মুখ্যমন্ত্রী নিজে একজন মেরুদণ্ডী রাজনীতিক এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু অপরের মেরুদণ্ড তিনি বরদাস্ত করতে পারেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শুধু গুরুঙ্গ নয়, শেষ কয়েকবছরের ডায়রির পাতা ওলটালে এরকম আরও কয়েকটি নাম উঠে আসবে। যেমন, ছত্রধর মাহাতো, ডাঃ শ্যামাপদ গড়াই, শিলাদিত্য, টুম্পা-মৌসুমী প্রমুখ। পুলিশ আধিকারিকদের মধ্যে সৌমেন মিত্র, জয়রামনরাও মাথা তুলে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন।

তাহলে এই রাজ্যে লক্ষণরেখার সংজ্ঞা কী হল! উওরটা পাঠকের বিবেচনার জন্যই তোলা থাক।

Spread the love

Check Also

এক মাসের মধ্যে  ডিপফেক ভিডিয়োর কোপে চার বলি তারকা

চ্যানেল হিন্দুস্তান, বিনোদন ডেক্স, চলতি মাসের শুরুর দিকে সমাজমাধ্যমের পাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দনার …

মাতৃত্বকালীন সময়ে নিন্দুকেদের সপাটে জবাব দিলেন শুভশ্রী

চ্যানেল হিন্দুস্তান, বিনোদন ডেক্স, হইচই নেটপাড়ায় আর কিছুদিনের মধ্যেই আসছে শুভশ্রীর দ্বিতীয় সন্তান। অনেকেই মনে …

পিতৃহারা হলেন অভিনেতা আরমান, প্রয়াত পরিচালক রাজকুমার কোহলি

চ্যানেল হিন্দুস্তান, বিনোদন ডেক্স, প্রয়াত পরিচালক রাজ কুমার কোহলি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, আজ, শুক্রবার সকাল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *