কমলেন্দু সরকার :
দেশভাগের ৭০ বছর হল। দেশভাগ যে বাঙালি-জীবনের তা নিয়ে একটি বাংলা ছবির হয়ে গেল ৬৬ বছর। এই ছবির পরিচালক নিমাই ঘোষ। চিত্রনাট্য আর চিত্রগ্রহণও ছিল পরিচালকেরই। অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, শান্তি মিত্র, শোভা সেন প্রমুখ। ছিলেন অনেক ছিন্নমূল মানুষও।
পুববাংলার জলঙ্গী গ্রাম। গ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে মিল আর হিন্দু মুসলিমদের ভিতর সাম্প্রদায়িক ঐক্য ছিল অটুট। ছবির কেন্দ্রে রয়েছে শ্রীকান্ত এবং তার স্ত্রী বাতাসী। বাতাসী আসন্নপ্রসবা। কালোবাজারি, যুদ্ধ, দেশভাগ সবকিছুরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর আন্দোলনে সবসময়ইই এগিয়ে যায় শ্রীকান্ত। ওদিকে কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধি পুলিশ শ্রীকান্তকে গ্রেফতার করে। দেশভাগের ফলে দাঙ্গা বাধে পাশের গ্রামে। গ্রামের হিন্দুরা মোড়লের সঙ্গে দেশ ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। চলেও আসে। বাতাসীও চলে আসে কলকাতা।
কলকাতায় তাদের ঠাঁই হয় না। ওরা বাধ্য হয় শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নিতে। শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। ছিন্নমূল মানুষেরা দখল নিল এক ধনীর পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানেই ভূমিষ্ঠ হল বাতাসীর সন্তান। শ্রীকান্ত জেল থেকে ছাড়া পেল একদিন। ফিরল গ্রামে। কেউ নেই। ববাতাসীও নেই। সে জানতে পারল ওরা সবাই চলে গেছে কলকাতা। শ্রীকান্তও কলকাতা রওনা দিল। পথে অনেক বাধাবিপত্তি। অবশেষে শ্রীকান্ত দেখা পেল গ্রামের মানুষজনের। বাতাসী তখন মৃত্যুশয্যায়। শোনা যায় ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের কান্না।
‘ছিন্নমূল’ বাংলা তো বটেই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নিও রিয়্যালিজমের সূচনা। বাঙালির জীবনে দেশভাগ যে চরম সর্বনাশ তা পরিচালক নিমাই ঘোষ মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। ছিন্নমূল মানুষের জীবন্ত দলিল এই ছবিটি। ছবিটিতে পরিচালক পুব বাংলার কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার নিমাই ঘোষ ছবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য মেক-আপ ছাড়াই অভিনয় করিয়েছিলেন। শিয়ালদা স্টেশনের দৃশ্যে সত্যিকারের ছিন্নমূল মানুষদের উপস্থিতি ছবিটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রী আর প্রকৃত ছিন্নমূল মানুষ কোথায় যেন একাকার হয়ে যায়। দেশভাগের যন্ত্রণা মুচড়ে ওঠে।
পরিচালক নিমাই ঘোষ সারা ছবিতেই সুন্দরভাবে সিনেমার ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার বিশ্ববরেণ্য পরিচালক কলকাতায় যখন এসেছিলেন তখন ‘ছিন্নমূল’ দেখেছিলেন। দেশে ফিরে ‘প্রাভদা’য় লিখেওছিলেন ছবিটি নিয়ে। এই উদ্বাস্তু সমস্যা সারা বিশ্বের সংকট।
জানা যায় ‘ছিন্নমূল’ মুক্তির সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে আপত্তি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির। তাদের থাকারই কথা। আজও তার ব্যতিক্রম দেখি না কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তবে তৎকালীন চেয়ারম্যান বীরেন্দ্রনাথ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে সেন্সর সার্টিফিকেট পেয়েছিল ‘ছিন্নমূল’।
সেইসময় এমন একটা ছবি করার সাহস দেখিয়েছিলেন নিমাই ঘোষ। ইনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে অরোরা ফিল্ম কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান বিভূতি দাসের সহকারী হিসেবে। শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্বে শ্রমিকদের পক্ষ নেওয়াই চাকরি যায় নিমাই ঘোষের। তিনি প্রথম স্বাধীনভাবে ক্যামেরাম্যানের কাজ করেন পরিচালক খগেন রায়ের ‘প্রতিমা’ ছবিতে। পরে বিমল দে-র সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে গণনাট্যে যোগাযোগ। তারপর স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের গল্প ‘নোঙর ছেঁড়া নৌকো’ কাহিনি নিয়ে করলেন ‘ছিন্নমূল’। নিমাই ঘোষের এই ছবি কার্লো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। তবে কলকাতায় কোনও কাজ না-পেয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন মাদ্রাজ। সেখানে তামিল ছবিতে কাজ করেন। নিমাই ঘোষের মতো পরিচালকের চলে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছিল বাংলা ছবিরই। দেশভাগের ৭০ বছরে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ভীষণভাবে মনে করিয়ে দেয়।