Breaking News
Home / TRENDING / উত্তমকুমার বলেছিলেন ছবি বিশ্বাস নেই আমি ব্যারিস্টারের ছেলে হতে পারব না

উত্তমকুমার বলেছিলেন ছবি বিশ্বাস নেই আমি ব্যারিস্টারের ছেলে হতে পারব না

কমলেন্দু সরকার  :

ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুর পর উত্তমকুমার বলেছিলেন, ‘আমার আর ব্যারিস্টারের ছেলের অভিনয় করা হবে না।’
ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুর পর বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ১৯৫৮ সনে যখন ‘জলসাঘর’ ছবি করব বলে মনস্থ করি, তখন বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য ছবি বিশ্বাসের চেয়ে যোগ্যতর অভিনেতা কেউ ছিলেন না। কিঞ্চিৎ দ্বিধা সত্ত্বেও তাই তাঁর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল আমাকে। দ্বিধা বলছি এই কারণে যে ব্যক্তিটিকে মানুষ হিসেবে তখনও চিনিনি; জানতাম legend হিসাবে এবং এই legendটি সম্পর্কে অল্পবিস্তর অপবাদও আমার কর্ণগোচর হয়েছিল—- পরিচালক হিসাবে যা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছিল।… ছবিবাবুর মতো অভিনেতা না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না।
১৯০২-এর ১৩ জুলাই ছবি বিশ্বাস জন্মেছিলেন বিডন স্ট্রিটের এক বনেদি পরিবারে। বাবা ভূপতিনাথ বিশ্বাস। মা কাত্যায়নী বিশ্বাস। খুব সুন্দর দেখতে বলে মা কাত্যায়নী তাঁকে ডাকতেন ছবি। আসল নাম শচীন্দ্রনাথ। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেন ছবি নামেই। ছবি বিশ্বাসের অভিনয় স্পৃহা ছিল ছোট থেকেই। যৌথ পরিবারে ভাই-বোন সবাই মিলে আবৃতি, গান, নাটক—- এসব চলত। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলত। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। হিন্দু স্কুল থেকে পাশ করার পর ভরতি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বন্ধুদের জন্য প্রেসিডেন্সি ছেড়ে গেলেন বিদ্যাসাগর কলেজে।
ছবি বিশ্বাস সঙ্গীতচর্চাও করেছিলেন। নাড়া বেঁধেছিলেন ওস্তাদ জামিরুদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে। অভিনয়জীবনের হাতেখড়ি মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় বারবেলা বৈঠক ক্লাবে। এখান ছিল শখের অভিনয়। করেছিলেন নাটক ‘ভীষ্ম’। ১৯৩৮-এ নাট্যনিকেতন মঞ্চে পেশাদারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। নাটক— সমাজ।
সিনেমায় অভিনয় করাটা হঠাৎই। একদিন ছবি বিশ্বাস কর্নওয়ালিস ক্রাউন (উত্তরা সিনেমার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলেন। সেইসময় বুকিংয়ে বসেছিলেন প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। তিনি ছিলেন ম্যাডন কোম্পানির মাইনে করা পরিচালক। তিনি ডাকলেন ছবি বিশ্বাসকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিনেমা করবেন।’
ছবি বিশ্বাস একপায়ে খাঁড়া। সম্মতি জানালেন। পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী তখন করছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। ছবি বিশ্বাসকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি। পরিচালকের পছন্দ হল ছবি বিশ্বাসকে। কালী ফিল্মসের ব্যানারে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬)ই হল ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবি। সকলেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের প্রশংসা করলেন।
‘অন্নপূর্ণার মন্দির’-এ ছবি বিশ্বাসের নাম হলেও নতুন কোনও ছবির অফার তাঁর কাছে আর আসে না। তিনি এ স্টুডিয়ো ও স্টুডিয়ো ঘুরে বেড়ান। একদিন একজন বললেন, ‘আপনি যতই ঘোরাঘুরি করুন কাজ আপনি পাবেন না। আপনার বদনাম করে বেড়াচ্ছেন কমেডিয়ান নৃপতি চাটুয্যে।’
নৃপতিকে চেনেন না ছবি বিশ্বাস। একদিন স্টুডিয়োরই একজন চিনিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ওই যে ঢাঙা মতো রোগা লোকটি যাচ্ছেন, উনিই নৃপতি।’
ছবি বিশ্বাস ডাকলেন, ‘ও মশাই শুনছেন।’
পিছন ফিরে নৃপতি বললেন, ‘আমাকে ডাকছেন?’
‘আপনাকে ছাড়া আর কাকে ডাকবো শুনি। আছেটা কে এখানে!’ ছবি বিশ্বাস খেপে আছেন নৃপতির ওপর।
নৃপতি সামনে এসে বললেন, ‘বলুন। কি বলতে চান?’
ছবি বিশ্বাস অভিযোগের সুরে বললেন, ‘আপনি আমার বদনাম করছেন কেন? আমি আপনার পাকাধানে কী মইটা দিয়েছি বলুন তো!’
নৃপতি ততোধিক শান্ত। বললেন, ‘আপনি খারাপ অভিনয় করেছেন বলব না! আপনার এমন আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা। যে-চরিত্র করছেন তার চলনবলন, হাঁটাচলা শিখতে হবে তো! আপনি হাঁটাচলা, কথা বলা নিয়মিত প্র‍্যাকটিস করুন। শিখুন। দেখবেন একদিন আপনি অনেকদূর যাবেন।’
ছবি বিশ্বাস বুঝলেন ঠিকই বলছেন তিনি। পুরোপুরি নৃপতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কী করতে হবে প্রভু?’
নৃপতির সঙ্গে সারা জীবনের সম্পর্ক তৈরি হল ছবি বিশ্বাসের। নৃপতি তাঁর বাড়ির একটা ঘরে ছবি বিশ্বাসের জন্য আলাদা একটা বিছানা করে রেখেছিলেন। ছবি বিশ্বাস এলে সেখানেই বিশ্রাম নিতেন। এমনকী ছবি বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর ওই বিছানা পাতাই থাকত। কাউকে বসতে দিতেন না, নিজেও কোনওদিন বসেননি। এমনটাই শ্রদ্ধা ছিল ছবি বিশ্বাসের ওপর।
এরপর থেকে ছবি বিশ্বাসের কাছে ছবির অফার আসতে শুরু করল। ছবি বিশ্বাস নিজেকে বদলালেন। অভিনয়েও এল আমূল পরিবর্তন। প্রতিবছরই ছবির সংখ্যাও বাড়তে লাগল। ১৯৪২ থেকে প্রতিবছর ১৩-১৪টি ছবি করতে লাগলেন ছবি বিশ্বাস। পরবর্তী কালে ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ করেছিলেন তিনি। কীসব করে গেছেন তিনি। কতরকম চরিত্র তিনি যে করেছেন, ভাবনার বাইরে! তবে শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্র পরিচালিত ‘মানিক’ বোধহয় একেবারে ভিন্ন ছবি ছিল তাঁর অভিনয়জীবনে। এই ছবিতে ছবি বিশ্বাসের সংলাপ ছিল না। পুরো ছবিটাই ছিল শুয়ে শুয়ে। আজও বাংলা ছবির দর্শক মনে রেখেছেন ‘সপ্তপদী’র উত্তমকুমারের বাবার ভূমিকা, ‘দেবী’র চরিত্র। এমনভাবে বলতে গেলে বিশাল এক তালিকা তৈরি হবে। তবে ‘একদিন রাত্রে’র ছবি বিশ্বাসের কণ্ঠে মান্না দে’র গাওয়া ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি’ গানের দৃশ্য আজও বর্ষীয়ান দর্শকের চোখে ভাসে। একেবারে ভিন্ন ধরনের চরিত্র করেছিলেন ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবিতে।
বাংলা ছবিতে ছবি বিশ্বাসের আভিজাত্যপূর্ণ চেহারার অভিনেতা আসেননি। আসেননি এমন বড় মাপের অভিনেতা। তিনি ছিলেন একটা যুগ। বাংলা ছবিতে চলনবলন, পোশাকে এনেছিলেন পরিবর্তন। তাঁর অভিনয় ছিল ভীষণই সিনেম্যাটিক। থিয়েটারি প্রভাবকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন মঞ্চসফল অভিনেতা। নাটক নিয়ে ছবি বিশ্বাস আর নৃপতির একটা মজার গল্প খুব চালু। স্টারে সেই নাটকের শো। ছবি বিশ্বাস এসেছেন নৃপতি তাঁর কাছে ১০ টাকা চাইলেন। ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘পাবে না।’ নৃপতি বললেন, ‘দিবি না।’ ছবি বিশ্বাস কিছুতেই টাকা দিলেন না। নৃপতি বললেন, ‘দিলি না তো। আজ তোর কী অবস্থা করি দেখ!’ কলকাতায় প্রচণ্ড গরম পড়েছে সেদিন। নাটকে একটা দৃশ্যে আছে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবেন ছবি বিশ্বাস। আর কম্বলটা খুলবেন নৃপতি এসে। নাটক শুরু হয়েছে। সেই দৃশ্যটিও চলছে মঞ্চে। নৃপতি কিছুতেই আর কম্বল খুলছেন না। কম্বলের ঘেমে নেয়ে উঠেছেন ছবি বিশ্বাস। আর নৃপতি দর্শকের দিকে পিছন ফিরে ছবি বিশ্বাসকে বলে যাচ্ছেন, ‘দশ টাকা দিবি কিনা বল।’ ছবি বিশ্বাস শেষপর্যন্ত না-পেরে উঠে বললেন, ‘দেব। এখন কম্বলটা তো খোল।’ ১০ টাকা পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে কম্বল খুলে দিলেন নৃপতি।
ছবি বিশ্বাসের মদ্যপানের গল্পও আছে বহু। তার মধ্যে একটা হল—- একদিন তাঁর মদ্যপানের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছিল। সেদিন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল কলকাতায়। বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে দেখেন পাহারারত একটি পুলিশ কাঁপছে। তিনি বললেন, আপনি ওপরে গিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন আর আমি আপনার হয়ে ডিউটি করে দিচ্ছি। পুলিশ যত বলে, এ আবার হয় নাকি! ছবি ততই নাছোড়বান্দা। শেষে গোলমাল শুনে ছবি বিশ্বাসের স্ত্রী ওপর থেকে নেমে বাড়ি নিয়ে যান।
ছবি বিশ্বাস একাধিকবার বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সম্মানও। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছিলেন আম বাঙালির মন জিতেআকাদেমি সম্মানও। তার চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছিলেন আম বাঙালির মন জিতে। তিনি দু’টি ছবি পরিচালাও করেছিলেন।
১৯৬২-র ১১ জুন এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান ছবি বিশ্বাস।

ছবি বিশ্বাসের জন্মদিনে চ্যানেল হিন্দুস্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

 

 

লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন

বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Spread the love

Check Also

Big Breaking: হুমায়ুনকে ওয়েসির ‘ফিলার,’ কী উত্তর দিলেন তৃণমূলের বিধায়ক

দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় হুমায়ুনকে ওয়েসির ফোন! দল তাঁকে শো-কজ করেছে। তিনি সেই শো-কজের উত্তরও দিয়েছেন। তাতেও …

রাহুলের পাইলট প্রোজেক্ট, মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসে আধিপত্য হারাতে পারেন অধীর

দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে রাহুল গান্ধির নতুন উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস রাজনীতিতে খর্ব হতে পারে অধীর …

আমি আসছি! নাম না করে শুভেন্দুকে শাসালেন আনিসুর

চ্যানেল হিন্দুস্থান, নিউজ ডেস্ক: নাম না করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারিকে শাসালেন আনিসুর রহমান। একদা …

One comment

  1. খুব ভাল লাগল লেখাটি। অনেক না-জানা তথ্য। ধন্যবাদ চ্যানেল হিন্দুস্তানকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *