জয়ন্ত ঘোষাল :
লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া ও কন্যা আয়োজন করেছেন মাছ মাংস দই মিষ্টি। আদবানি নিজে নিরামিষভোজী হলেও তাঁর সিন্ধ্রি পরিবার আমিষ খান। তাঁর নিরামিষ খাওৎা ছিল তাঁর নিজস্ব পছন্দের বিষয়। আর বাঙালি বুদ্ধবাবুকে বাড়িতে ডেকে নিরামিষ খেতে দেবেন? তা আবার হয় নাকি! এমনিতেই জানা ছিল সুকান্তর ভ্রাতুষ্পুত্রটি মাছ খেতে ভালোবাসেন। মাছের ঝোল আর ভাত। এই ছিল বুদ্ধবাবুর পছন্দের পদ। তাই মাছের পদ, মাংসের পদ। সঙ্গে বাঙালির প্রিয় মিষ্টি দই, রসগোল্লা। সেদিন স্বল্পাহারী বুদ্ধবাবু মাছ মাংস ছুঁয়ে দেখেননি। শুধুমাত্র দই দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন।
আমার ইচ্ছে ছিল এই সময়টাতে উপস্থিত থাকব। চাক্ষুষ করব একজন বামপন্থী নেতার সঙ্গে একজন দক্ষিণপন্থী নেতা কেমন করে খাবার টেবিল শেয়ার করেন! রামমন্দির আন্দোলনের প্রধান স্থপতির সঙ্গে কী কথা হয় বুদ্ধবাবুর মতো একজন বামনেতার!
আদবানির বাড়িতে তখন আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। সর্বদা অবারিত দ্বার। ওঁকে বললাম, আমি থাকতে চাই। আপনাদের বৈঠকের সময় ঘরের বাইরে থাকব কিন্তু ঘটনাটা কেমন ভাবে ঘটবে নিজের চোখে দেখতে চাই। সেদিন আদবানি আমাকে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার বাড়িতে তুমি যে কোনও সময় আসতে পারো। কিন্তু আজ আমি গৃহকর্তা। অতিথি আসছেন। তুমি বাংলা কাগজের সাংবাদিক। অতিথি যদি মনে করেন, এই আমন্ত্রণ পর্বটি আমি খবর করাতে চাইছি! তাই তোমাকে ডেকে এনেছি। উনি যদি অস্বস্তি বোধ করেন! সেটা কী ভালো হবে?
সেদিন আদবানির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। দেশের উপ প্রধানমন্ত্রী আদবানি সপরিবারে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন।
জ্যোতিবাবু যে দলকে অসভ্য বর্বর বলতেন, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে বুদ্ধবাবু সেই দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে সখ্যতায় সংকোচ করেননি। আসলে আদবানি আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দুজনেই ইনক্লিউসিভনেস পছন্দ করতেন। সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করতেন। রাজনৈতিক ভাবে বিপরীত মেরু হলেও ব্যক্তি সম্পর্ক তৈরি করা যায়, সেই সম্পর্ক রক্ষা করা যায়… দুজনেই সম্ভবত এই ভাবেই ভাবতেন। ওঁদের সম্পর্কের জোর এতটাই ছিল যে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের জট ছাড়াবার বৈঠক, বৈঠক হচ্ছে নর্থ ব্লকে। বৈঠক করছেন কে? আদবানি। বুদ্ধবাবু সেখানে উপস্থিতই নেই! এমন দৃশ্য এখনকার দিনে ভাবা কঠিন।
একদা কট্টর বিজেপি বিরোধী জ্যোতিবাবুকেও বাজপেয়ী-আদবানি সমীপে নিয়ে গেছিলেন এই বুদ্ধবাবুই। ভিপি সিংহ সরকার তৈরি হবার আগের কথা। জ্যোতিবাবু বললেন, বিজেপি নেতার সঙ্গে একজন কম্যুনিস্ট নেতা বৈঠক করবে! মানুষ ভালো ভাবে নেবে না। এই বৈঠকের কথা গোপন রাখতে হবে। তখন শিল্পপতি বীরেন জে শাহ তাঁর অশোকা হোটেলে বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন। তখনও তিনি রাজ্যপাল হননি। এরপর একদিকে বাম ও আর এক দিকে বিজেপির সমর্থনে ভিপি সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে অবশ্য জ্যোতিবাবুকে বাজপেয়ীর সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা গেছিল। সেটা অবশ্য অন্য ইতিহাস।
‘বাবরি ধ্বংসকারী’ আদবানির সঙ্গে সখ্যতা করলে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে প্রভাব পড়বে কিনা, এই কথা বুদ্ধবাবুকে ভাবতে হয়নি। তিনি উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। স্বপ্ন বুকে নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিরোধিতা করেছেন। তাঁর অবস্থান থেকে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধু বিরোধীরা নয়, নিজের দলের মধ্যেও অজস্র বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি। সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়েও তাঁর বেশি বিরোধী ছিলেন প্রকাশ কারাত। বুদ্ধবাবু কম্যুনিস্ট পার্টির ভারতীয় মডেলের পক্ষপাতী ছিলেন। চিনের চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি যেমন চিনের উপযোগী কম্যুনিস্ট পার্টিতে বিশ্বাসী। বুদ্ধবাবুও সেই ভাবে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি চেয়েছিলেন। তিনি ভাবনায় এগিয়ে ছিলেন। তাই একা হয়ে গেছিলেন।
নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন তিনি। কখনও পড়া। কখনও লেখা। কখনও শুধুই ভাবা।
আজ তিনি নেই। এমন শূণ্যতায় তাঁর ভাবনা রয়ে গেল!