কমলেন্দু সরকার :
বিকাশ রায়ের জন্ম ভবানীপুরে। আদিনিবাস নদিয়ার প্রিয়নগর। পড়াশোনা মিত্র ইনস্টিটিউশন-এ। ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ম্যাট্রিক পাশের পর ভরতি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিকাশ রায়ের ইংরাজি উচ্চারণ ছিল একেবারে সাহেবি কেতার।
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় মেতেছিলেন সাহিত্য নিয়ে। কলেজ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। একটি পত্রিকাও বার করেছিলেন। পত্রিকার নাম ছিল—- বেদুইন। এই সাহিত্যচর্চার সুবাদে পরবর্তী কালে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহ পেয়েছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘আনন্দলোক’-এ।
যাই হোক, ১৯৩৬-এ প্রেসিডেন্সি থেকে বিএ স্নাতক হলেন। তারপর ১৯৪১-এ এলএলবি। কিছুদিন ওকালতি করলেন আলিপুর কোর্টে। মন টিকল না। ওকালতি করার সময় আলাপ হয়েছিল ড্রুকার সাহেবের সঙ্গে। সেই সুবাদে সিভিল ডিফেন্স-এ ঢুকলেন। এখানেও ভাল লাগল না। এলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে। এরপর বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার-এ। কিছুদিন পর আবার রেডিয়োতে এলেন প্রোগ্রাম আসিস্ট্যান্ট হয়ে।
এই রেডিয়ো জীবনের অভিজ্ঞতা বিকাশ রায়ের অভিনয় জীবনে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ এবং ওই কেটে কেটে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়ে একটা ধারা তৈরি করেছিল। এবং সেখানে সফল হয়েছিলেন তিনি।
যদিও বিকাশ রায়ের পরিবারে ছি অভিনয়চর্চা। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি পরিচালনা করেছিলেন ‘চন্দ্রগুপ্ত’। তিনি হয়েছিলেন সিকন্দর। প্রেসিডেন্সির সোশ্যালে করেছিলেন ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ বিনোদের চরিত্র। পেয়েছিলেন ব্যাপক প্রশংসাও।
রেডিয়োতে চাকরি করার সময় আলাপ হয়েছিল লেখক জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে। এই সাহিত্যিকের লেখা ‘উদয়ের পথে’ নিয়ে ছবি করছেন পরিচালক বিমল রায়। সেই সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল ‘উদয়ের পথে’। বইটির কাটতিও ছিল।
জ্যোতির্ময় রায় ঠিক করলেন ছবি করবেন। পরিচালক হবেন। ছবির কাজ শুরু হল। নাম ‘অভিযাত্রী’। এই ছবিতেই বিকাশ রায় প্রথম অভিনয় করলেন। সময়টা ১৯৪৭। কিন্তু দর্শকের নজরে আসেন তিনি ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছবিতে। পরিচালক হেমেন গুপ্ত। ছবির নায়ক প্রদীপকুমার। বিকাশ রায় করেছিলেন মহানন্দ-এর ভূমিকা। মহানন্দ ছিল এক বিপ্লবী। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। পুলিশ লাঠিপেটা করছে, আধমরা অবস্থা তবুও মহানন্দ অর্থাৎ বিকাশ রায় ‘বন্দেমাতরম’ বলে চেঁচিয়ে উঠছেন। সারা প্রেক্ষাগৃহ চমকে উঠছে ওই চিৎকারে। আবার যখন মহানন্দের অন্য ভূমিকা তখন আবার বিকাশ রায়ের অন্য অভিনয়। মহানন্দ তখন পুলিশের চর। নায়কের হাতে গুলি খেয়ে যখন মারা যাচ্ছেন বিকাশ রায় ওরফে মহানন্দ তখন তিনি অনুশোচনায় আর অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়েছেন। অপূর্ব অভিনয়! জন্ম নিল বাংলা ছবির এক অভিনেতা। তাঁর নাম—- বিকাশ রায়।
এই পরিচালক হেমেন গুপ্তের ছবি ‘৪২’ (১৯৫১)। বিকাশ রায় এক অত্যাচারী পুলিশ অফিসার ত্রিবেদী। পুরো খলনায়কের চরিত্র। তাঁর নির্মম অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের অভিনয় দেখে আতঙ্কিত হয়ে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকেরা। শোনা কথা, অনেক দর্শকও নাকি জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন সিনেমার পরদায়। এমনকী তিনি নাকি বাড়ি থেকেও বেরোতে পারেননি কিছুদিন। এমন ঘৃণা আর অভিনয় স্বীকৃতি কোনও অভিনেতার জুটেছে কিনা সন্দেহ!
যদিও ‘৪২’ মুক্তি পাওয়ার আগে পরিচালক দেবকী বসুর ‘রত্নদীপ’ (১৯৫১) এবং অজয় কর-এর ‘জিঘাংসা’য় (১৯৫১) দর্শক দেখেছেন অন্য এক বিকাশ রায়কে। ‘জিঘাংসা’ তিনি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছিলেন। ‘জিঘাংসা’ ছবিতে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বিতর্কে। ধীরাজ ভট্টাচার্য নাকি বলেছিলেন, বিকাশ রায় নাকি কপি করেছিলেন তাঁর ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ ছবির অভিনয়!
‘জিঘাংসা’ হিট ছবি। ছবি প্রযোজনায় উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪-তে তৈরি করেছিলেন বিকাশ রায় প্রোডাকশনস। একাধিক ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। কোনওটা ফ্লপ, আবার কোনওটা হিট হয়েছিল। বিকাশ রায় ছিলেন সুচিত্রা সেনের নায়কও। পরিচালনা করেছিলেন ‘বসন্ত বাহার’ (১৯৫৭), ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ (১৯৫৯), ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ (১৯৬১), ‘কাজললতা’ (১৯৭৫)-র মতো ছবিও। এছাড়াও পরিচালক ছিলেন ‘অর্ধাঙ্গিনী’ (১৯৫৫), ‘সূর্যমুখী’ (১৯৫৬), ‘নতুন প্রভাত’ (১৯৫৭), ‘রাজাসাজা’ (১৯৬০) ছবিরও। এর মধ্যে নতুন প্রভাত আর রাজাসাজা ছিল বিকাশ রায়ের নিজের লেখা গল্প।
বিকাশ রায়ের বহু অভিনয়ই মনে রেখেছেন বাংলা ছবির দর্শক। ‘৪২’ তো বটেই ‘আরোগ্য নিকতন’-এ আজও বিকাশ রায়কে মনে করায়।
শুধু পরদায় নয়, মঞ্চেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গেও দাপটে অভিনয় করেছেন। করেছেন শ্রুতিনাটকও। তাঁর অভিনীত শ্রুতিনাটক ‘শেষের কবিতা’ আজও স্মৃতিরসরণিতে নিয়ে যায়।
Check Also
চোরেদের মন্ত্রীসভা… কেন বলেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক
ডঃ অরিন্দম বিশ্বাস : আজ বাংলার এবং বাঙালির রাজনীতির এক মহিরুহ চলে গেলেন। শ্রী বুদ্ধদেব …
আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ
জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …
নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই
সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …