দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় :
শাবাশ! সরকার! শাবাশ তৃণমূল! শাবাশ পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! পদাতিক সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আপনার কাছে কয়েকটি নিবেদন। যে-সরকার নিজেকে নিরন্তর মানুষের সরকার বলে দাবি করে ও প্রচার করে, যে-সরকারের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে মা মাটি মানুষের মতো একটি কাব্যিক শব্দবন্ধ সেই সরকারের পুলিশ এবং সাংবাদিকদের পিঠ লক্ষ্য করা লাঠিকে সাবাশি না জানিয়ে আর কিই-বা করার আছে।
বামেদের সঙ্গে আপনার চির বিরোধিতার সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের একটি ভূমিকা চিরকাল রয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে রাজনৈতিক মতামতে বা আপনার রাজনীতির ধরনে মিল না থাকলেও শুধুমাত্র মানবিকতার কারণে সংবাদমাধ্যম বা বলা ভাল যাঁরা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা করেন তাঁরা আপনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভবত তাঁরাও রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আপনার মানবিক মুখকে গুরুত্ব দিয়ে আপনার সমব্যথী হয়েছেন। সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা, সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় লাইন এসবের বাইরেও রাজনীতিক ও সাংবাদিকের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়। রাজনীতিকদের সম্পর্কে সাংবাদিকদের যেমন একটি ধারণা তৈরি হয় তেমনই সাংবাদিকদের সম্পর্কেও ধারণা তৈরি হয় রাজনীতিকদের। আপনার মা মাটি মানুষের সরকারে শুরু এবং শেষ হলেন আপনি। ঠিক যেমন ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসে সবটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৬-র নির্বাচনের আগে আপনি ঘোষণা করেছিলেন সবক’টি আসনে আপনিই লড়ছেন। শুধু ঘোষণা নয়, নির্বাচনের ফলাফল আপনার ঘোষণাকে সম্মান দিয়েছিল। ফলত সাংবাদিকদের ওপর লাঠি চালানোর কোনও দায় যদি পুলিশের থেকে থাকে তাহলে সেই দায় সমানভাবে আপনারও। বরং আপনার দায় বেশি।
বাম নেতাদের সঙ্গে আপনি ফিশ ফ্রাই সহযোগে চা খাবেন আমরা খবর করব। বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আপনি বামেদের আহ্বান জানাবেন আমরা খবর করব। বামেদের মিছিল নবান্নের দরজায় উপস্থিত হয়ে পুলিশের দিকে ইট ছুড়বে আমরা খবর করব। ইট বৃষ্টি রুখতে পুলিশ লাঠি চালাবে আমরা খবর করব। কোন যুক্তিতে পুলিশের লাঠি সাংবাদিকদের পিঠ লক্ষ্য করে নেমে আসবে, কখনও বা মাথা লক্ষ্য করে নেমে আসবে এর কোনও ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে কী! কার নির্দেশে পুলিশ সাংবাদিক নিগ্রহ করল এর সদুত্তর নবান্নের কোথায় গেলে পাওয়া যাবে?
নন্দীগ্রাম যাওয়ার পথে রেয়াপাড়ায় সিপিএমের ক্যাডাররা সাংবাদিকদের যারপরনায় নিগ্রহ করেছিল। আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন। আজ যে-নিগ্রহের ঘটনা ঘটল তাতে আপনার প্রতিবাদী মন কীভাবে সাড়া দিচ্ছে জানতে আগ্রহ হয়। কোথাও খবর করতে গিয়ে মার খাওয়া সাংবাদিকদের কাজের অঙ্গ। সাধারণত প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস বলেই আমরা বিষয়টিকে এড়িয়ে যাই। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে মার খাওয়া সাংবাদিকদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এদেশে শিক্ষার স্তর এখনও সেই জায়গায় পৌঁছয়নি যে আমরা আশা করতে পারি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীরা, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, সাংবাদিকদের কাজের মর্যাদা দেবেন। একথা মেনে নিতে দ্বিধা করব না যেমন রাজনীতিতে, যেমন প্রশাসনে তেমনই সম্ভবত সময়ের নিয়মে সাংবাদিকতাতেও বেনোজল ঢুকেছে। উদ্দেশ্য প্রণোদিত সাংবাদিকতা, পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতা গোটা পৃথিবীতে যেমন রয়েছে এদেশেও তার ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু এসবই সংবাদমাধ্যমের নীতি নির্ধারণের বিষয়। আর একটু পরিষ্কার করে বললে ব্যবসার লাভক্ষতির বিষয়। এর সঙ্গে যে ছেলেটা বা মেয়েটা পিচগলা রোদ্দুরে ‘ডিউটি’ করছে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, এই কথাগুলি আপনি জানেন না এমনটাও নয়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই পর্বে সাংবাদিকরা তৃণমূল কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হলে আপনি আপনার কর্মীদের বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘ওঁদের হাউস যাই করুক না কেন ওঁরা কাজ করে, ওঁদের দোষ নেই’। ২০১১-ই রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এসেছিল আপনার মুখের দিকে চেয়েই। ২০১৬-ই আবার শুধুমাত্র আপনাকে ভরসা করে রাজ্যের মানুষ তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেছে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে আপনার ভাবনায়, চেতনায় সাংবাদিকদের প্রতি মনোভাবে কোনও পরিবর্তন আসেনি তো! আশা করি আসেনি। আশা করি ২২ মে-র ঘটনা নেহাত ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। আপনি কবিতা লেখেন, ছবি আঁকেন, কবিতা পড়েনও। আপনাকে বলি এই সময়ের একজন প্রধান কবির আক্ষেপের কথা। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন তাঁর কবিতা কিছুতেই একটি বহুল প্রচারিত সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেত না। সেটা ছিল সেই কবির সংকট। আর আজ তিনি যাই লেখেন তা সেই বড় পত্রিকায় প্রকাশ পায়। কবির কাছে এটা আরও বড় সংকট। তাঁর স্তুতি করার লোকেরা তাঁকে ঘিরে থাকে তিনি যাই লেখেন তাতে বাহবা দেয়। কিন্তু আজ তাঁর ভুল ধরবার কেউ নেই। বা বলা ভাল তাঁকে সবাই খুশি রাখতেই এত মশগুল যে তাঁরা কবির ভুল ধরে তাঁর বিরাগভাজন হতে চায় না।
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা এই সংকট যেন আপনাকে গ্রাস না করে।
খুব ভাল লিখেছেন। আপনার এই খবর দেখে আগামীতে আমরাও কাজের উৎসাহ পাছি। চালিয়ে যান। থামবেন না।
Very well-written Mr. Debak Banerjee. Appreciate the courage of your pen.