গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়:
অমিত শাহ নিশ্চয় নির্বাচনী পাটিগণিতের সমীকরণ সেরে অঙ্কটা মিলিয়ে ফেলেছেন। দাদাকে শুধু কাছে টানা নয়, একেবারে চৌকাঠ পার করে অন্দরমহলে নিয়ে এসে ফেলেছেন। একদিকে ছেলে, অন্যদিকে দাদা। কী কম্বিনেশন! আর তাই তো জয়ের সৌরভে আমোদিত বাংলা।
সমস্যা বাধছে অন্যত্র। বাড়ির খিড়কি দরজা দিয়ে দাদার এই অকস্মাৎ প্রবেশের ফলে দলের অন্দরের পাটিগণিত যে একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল, তার দায় কে নেবে? দলে কি দাদাদের অভাব পড়িয়াছিল? না মোটেই না। দিলীপদা থেকে মুকুলদা, তাঁরা কী দোষ করলেন? অমিত শাহ যে জয় শাহের পাশের চেয়ারে প্রাক্তন ভারতীয় কপ্তানকে বসিয়ে বাংলার পল্লীতে পল্লীতে মলয় বাতাস বইয়ে দিলেন তাতে কি আগাম ঝড়ের চোনাটুকু ফেলে দিলেন না? তাইতো বঙ্গ বিজেপির খানদানি পরিবারে চওড়া হাসির আড়ালে কেমন একটা আড়ষ্টভাব। হিন্দিতে ইশারাহি কাফি হ্যায় বলে কী যেন একটা বলে না? এটা যেন সেরকমই একটা ইশারা। নয় কি? দেখুন, সত্যি কথা বলছি, সারা ভারতে বিজেপি দাপট দেখালেও মোদী-শাহ জুটি জানেন, বঙ্গবিজয় না হলে ষোলকলা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। আর সমস্যা সেখানেই। সেখানে আছেন এক দিদি। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দাদার সঙ্গে একাধিক দিদিকেও ময়দানে নামিয়েছে বিজেপি। লোকসভার ফলাফল দেখে বিজেপির হাসি আর ধরে না। তারা ধরেই নিয়েছে, সেদিন বিশেষ বাকি নেই যখন এই বাংলাও হয়তো গেয়ে উঠবে, বাংলা আমার পছ্ছিম বং, বিজেপি আমার স্বপ্ন গো। তবু খটকা লেগে থাকছিল। রাজ্য তো হাতে এল, রাজা কে হবেন?
বাংলার রাজা হওয়ার দৌড়ে বঙ্গ বিজেপিতে বহু দাদার নাম উঠছিল ঠিকই তবে তাঁদের নিয়ে যে বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটি খুব একটা ভাবিত নয় সে কথা বুঝতেও কারোর বাকি ছিল না। এরকম একটা সময়ে রাজনীতির বৃত্তের বাইরে বাংলার এক আইকনকে বেছে নিয়ে বসানো হল বিসিসিআইয়ের মাথায়। আহা! কী বাহার, কী বাহার! এরপরেও বলবেন, বিজেপির খান-এ-খানান গুনগুন করে গাইবেন না, ক্যা করে সজনি আ গয়ে বালম? আরে বাবা, সৌরভ গাঙ্গুলি লড়তে জানেন, ফরফরিয়ে হিন্দি-এংলিশ বলতে জানেন, দাদাগিরি করতে জানেন, বিলিতি কেতা-বাঙালি কেতা মেলাতে জানেন। বাংলার নয়নের মণি হতে জানেন, লর্ডসের মাঠে জামা ওড়াতে জানেন, অউর ক্যায়া? আরও চাই? তবে শুনুন, যে মাটিতে পড়ে যান সেই মাটি আঁকড়ে উঠতে জানেন, মায়ের ভাসানে নাচতে জানেন, সুশীল বাঙালি আর কুটিল রাজনীতি খল-নুড়ি দিয়ে পিশতে জানেন। তবেই না খোদ অমিত শাহের সঙ্গে বাৎচিত সেরে নির্বিকার কণ্ঠে বাইরে এসে বলতে পারেন, রাজনীতির কো…ন…ও কথা হয়নি। মা চণ্ডীর কিরা, কী মেজাজ মাইরি। মাইকের সামনে কত্তা এমনই ভারী গলায় এ কথা বললেন যে গুরাতেও হাসবার সাহস দেখায় নাই।
এরপরেও দেখছি বঙ্গ বিজেপির নেতারা নবরত্ন তেলের খোঁজে মোড়ের মণিহারি দোকানে লাইন লাগাচ্ছেন। এত মাথা ব্যাথা কেন বলুন তো? কারণ মাথাতে সেই একটা কথাই যে ঘুরঘুর করছে, দোর্দণ্ডপ্রতাপান্বিত অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের পাশে বসেই তো ভারতীর ক্রিকেটের দরবার চালাবেন দাদা! আর কে না জানে, ক্রিকেটের দরবার চালানো আর বাংলার আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে থাকা একই বস্তু। এমনিতেই তো তিনি বঙ্গ বধূর থুড়ি বিধুর হৃদয়ে মমতার প্রলেপ, বঙ্গ তরুণের হৃদয়াকাশে সাত রঙা রামধনু। সেই জন্যই তো অঙ্ক মিলে গেল। একেবারে দুইয়ে দুইয়ে চার, একশোয় একশো। আর তাইতো বঙ্গ বিজেপির আকাশ যেন একটু থমথমে।
ফিসফিস শোনা যাচ্ছে, এটা কেমন জানি হয়ে গেল, তাই না? এই যে সামনে না থেকেও দিলীপ, মুকুলদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা। এই যে হঠাৎ যাদবপুর কাণ্ডে নাম না করেও দিলীপকে বিঁধে রাজ্যপালের সমালোচনা, এই যে মুকুলের পিছনে সিবিআইয়ের ফেউ লেগে যাওয়া আর অবশেষে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মাথায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বসিয়ে দেওয়া। তাহলে নবান্ন কাপের দখল নিতেই কি অমিত শাহের এই সৌরভ বাউন্সার? হবেও বা। আদার কারবারি আমি আর কতটুকুই বা জানি, এককালের জাহাজ মন্ত্রী হয়তো উত্তরটা জানতে পারেন। বা সঙ্ঘ সৈনিক হয়তো এ বিষয়ে আতম সমীক্ষা করে উত্তরটা বুঝে নিতে পারেন। আমি এটুকুই বুঝি, আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে বনবাসে যায়।
পুন: আবার নজরুলকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে জেলে নিয়ে যাবেন না। তিনি রামচন্দ্রকে নিয়ে গান লিখেছেন মাত্র, দেশদ্রোহিতা করেননি।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)