সুমন ভট্টাচার্য :
নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতিতে একটা ‘স্টাইল’ আছে। সেই ‘স্টাইল’-এর ‘সিগনেচার টিউন’ হচ্ছে অপ্রত্যাশিত চমক। ঠিক যেভাবে আচমকাই বিহারের রাজ্যপাল এবং দলিত নেতা রাম নাথ কোবিন্দ-এর নাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব করে তিনি সবাইকে চমকে দিলেন। বিরোধী জোট বা সংবাদ মাধ্যমে যে ক’টি নাম নিয়ে গত দু’মাসে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে রাম নাথ কোবিন্দ-এর নাম কোথাও কখনও ছিল না। অনেকে এর পিছনে দলিত রাজনীতি দেখতে পারছেন, আমি কিন্তু বিহার যোগাযোগের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করব। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার গত কয়েক মাস ধরেই ‘গাছেরও খাবো এবং তলারও কুড়োবো’ নীতি নিয়ে চলছেন। সনিয়া গান্ধীর দেওয়া মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করে নীতীশ তার ঠিক পরেরদিনই মরিশাসের সম্মানে দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর ভোজসভায় গিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই অনেকে মনে করেন, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য নীতীশ দু’তরফের জন্যই দরজা খুলে রাখছেন। অর্থাৎ সুযোগ এবং পরিস্থিতি আন্দাজ করে নীতীশ বিজেপি অথবা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের দিকে ঝুঁকবেন। বিহারের রাজ্যপালকে রাইসিনা হিল-এ নিয়ে আসার বিজেপি উদ্যোগের পিছনে নরেন্দ্র মোদী-নীতীশ কুমার সখ্য কোনও নতুন ইঙ্গিত নেই তো?
নেদারল্যান্ড রওনা হয়ে যাওয়ার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি রাম নাথ কোবিন্দ-এর নাম শোনেননি। অতএব বিজেপির দলিত প্রার্থীকে মেনে নিতে মোটেই রাজি নন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ঠিকই তো বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাম নাথ কোবিন্দকে প্রার্থী করা হতে পারে, এমন কথা কি বিজেপি-ই অনেক নেতা জানতেন? নিশ্চয় না। লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে মোহন ভাগবত, সুষমা স্বরাজ থেকে এম এস স্বামীনাথন- গত দু’মাসে বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে কত নাম নিয়েই না জল্পনা হয়েছে? ঝাড়খন্ডের রাজ্যপাল দ্রৌপদী মূর্মুই বিজেপির রাষ্ট্রপতি প্রাথী, এই রকম ভবিষ্যৎবাণী দিয়েই কত খবর লেখা হয়েছে। যারা ঝাডখণ্ডের রাজভবন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন, তারা কিন্তু বিহারের রাজভবনের বাসিন্দার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। কিন্তু ঠিক সময় নিজের আস্তিনের তাসটিকে সামনে এনে আবার নরেন্দ্র মোদী সবাইকে চমকে দিলেন। এটাই নরেন্দ্র মোদীর ‘স্টাইল অব অপারেশন’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাম নাথ কোবিন্দ-এর নাম নিয়ে আপত্তি তুলতে পারেন, কিন্তু বিদেশ সফরে চলে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির পাকা ঘুঁটিকে কতটাই বা কাঁচিয়ে দিতে পারবেন? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সনিয়া গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সীতারাম ইয়েচুরিরা যে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, সেটা আপাতত কতটা গড়ে উঠবে, তা বলা মুশকিল। মমতা চলে গেলেন বিদেশে, মায়াবতীর পক্ষে কোনও দলিত নেতার বিরুদ্ধোচারণ করাটা রাজনৈতিকভাবে ‘হারাকিরি’ হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই ভোটের অঙ্কে বিরোধীদের থেকে এগিয়ে থাকা গেরুয়া শিবির এবার দলিত কার্ড দিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিনে বিদেশ থেকে ফিরবেন, ততদিনে বিজেপি তাঁদের মনোনীত প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র জমা করিয়ে দেবে। শুধু তাই নয়, একজন দলিত প্রার্থীকে সামনে এনে হয়তো বিরোধী শিবির থেকে কোনও একটা অংশকে ভাঙিয়েও আনতে পারেন নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ। এবং সেটাই হবে এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির আপাত সাফল্য।
ব্যাঙ্কে টাকা রাখার মতোই রাজনীতিতে দু’ধরনের ‘ডিভিডেন্ড’ পাওয়া যায়। একটা ‘শর্ট টার্ম’, আর একটা ‘লং টার্ম’। রাম নাথ কোবিন্দ-এর প্রার্থীপদ ঘোষণা বিজেপিকে দুটো ‘ডিভিডেন্ড’ই দেবে। অপ্রত্যাশিত নাম সামনে এনে প্রথম ধাক্কায় যেমন বিরোধীদের কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিতে পেরেছেন অমিত শাহরা, তেমনই সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাস হিসাবেও এই দলিত নেতাকে ব্যবহার করতে পারবেন নরেন্দ্র মোদীরা। উচ্চবর্ণের দল হিসাবে বিজেপির গায়ে যে তকমা লেগেছিল, তা ঝেড়ে ফেলতে রাম নাথ কোবিন্দকে ‘আইকন’ হিসাবে ব্যবহার করবে বিজেপি। এদেশে মোট ভোটারদের ১৫ শতাংশ দলিত। কিন্তু গোবলয়ের অনেক রাজ্যেই দলিতরা নির্বাচনী পাটিগণিত উল্টে-পাল্টে দিতে পারে। ২০১৯ এবং ২০২৪এর নির্বাচনের দিকে তাকিয়েও গেরুয়া শিবির রাম নাথ কোবিন্দ-এর নামকে তুলে এনেছে। আপাতত সেই কারণেই ‘অ্যাডভান্টেজ’ নরেন্দ্র মোদী।