কমলেন্দু সরকার :
আজ থেকে বছর চোদ্দো আগে মঞ্চের মায়া কাটিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন কেতকী দত্ত। কেতকী দত্তের বাবা তারাকুমার ভাদুড়ি। মা প্রভা দেবী। আমার সঙ্গে কেতকীদির আলাপ মঞ্চে নয়, টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায়। সম্ভবত টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়োয়। ‘আনন্দলোক’ থেকে স্টুডিয়ো কভারেজে গিয়েছিলাম। সিরিয়ালের নাম স্মরণে নেই। কেতকীদি তখন ৬০-এর আশপাশে। সেই বয়সেও তিনি ভয়ংকর সুন্দরী! তারপর উষা গাঙ্গুলির ‘মুক্তি’ নাটকে দেখলাম তাঁর মঞ্চ অভিনয়। কী দাপুটে অভিনয়! মঞ্চ জুড়ে কেতকী দত্তের উপস্থিতি। এরপর একদিন ওঁর মিল্ক কলোনির বাড়িতে যাই।
কেতকী দত্তের মা প্রভা দেবী ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের নামীদামি অভিনেত্রী। সিনেমাও করেছেন। কেতকীদি ছিলেন মায়ের প্রতি ভীষণইই শ্রদ্ধাশীল। তিনি বলেছিলেন—- মা শুধু অভিনেত্রী ছিলেন তা নয়। ভাল কবিতা লিখতেন। ভাল গান লিখতেন মায়ের একটা গানের বইও ছিল— গীতায়ন। এই বইয়ের দু’টি গান রেকর্ডও করেছিলেন। বেশ মিষ্টি গলা ছিল। বাড়িতে মাঝমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান গাইতেন। বিশেষ করে, মায়ের গলায় নজরুলের ‘কাবেরী নদী জলে কে গো’ শুনলে মন ভরে যেত!
নিজের কথা কিছুতেই বলতে চাইতেন না কেতকীদি। উনি পেশাদার অভিনেত্রী। মায়ের হাত ধরেই শিশুশিল্পী হিসেবে মঞ্চে এসেছিলেন। ছোট বয়সে ছেলে সাজতেন। শুধু অভিনয় নয়, ভাল গানও গাইতেন। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘আন্টনি কবিয়াল’ যাঁরা দেখেছেন তাঁরা শুনেছেন কেতকী দত্তের গান। কেমন ছিল তাঁর কণ্ঠ! এই নাটকে তিনি করেছিলেন সৌদামিনী। আন্টনি করেছিলেন সবিতাব্রত দত্ত। আর ভোলা ময়রা জহর গাঙ্গুলি। দর্শক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। টানা আড়াই বছর চলেছিল ‘আন্টনি কবিয়াল’। এই নাটকটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ছিল যে নতুন করে নাটকপ্রেমীরা খোঁজ পেয়েছিলেন কলকাতা শহরে আর এক মঞ্চের!
কেতকী দত্ত ছিলেন বাংলা নাটকের এক স্বতন্ত্র প্রতিভা। অসীম চক্রবর্তীর সঙ্গে তিনি করেছিলে চতুর্মুখ-এর ‘জনৈকের মৃত্যু’। পরে সুবোধ ঘোষের ‘বারবধূ’। মঞ্চসফল নাটক। সেইসময় তেমনই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল এই নাটক ঘিরে। বামেরা তখন ‘বারবধূ’র ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অশ্লীলতার দায় চাপানো হয়েছিল ‘বারবধূ’র ওপর! শেষমেশ নাটক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন অসীম চক্রবর্তী। শোনা যায়, কেতকী দত্তের গায়েও নাকি দায় পড়েছিল অশ্লীলতার। তিনি বহু বছর কাজ পাননি। একসময় যাত্রাও করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু যাঁর রক্তে নাটকের প্রবাহ, তিনি কী অন্য কোনও মাধ্যমে আটকে থাকতে পারেন! পারেনওনি। আবার নাট্যমঞ্চে ফিরে এসেছিলেন। করেছিলেন উষ্ণিক-এর হয়ে ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘কমলে কামিনী’। এই নাটকে ছিল তাঁর একক অভিনয়। তিনি যে কতবড় মানের অভিনেত্রী ছিলেন বোঝা গেল। ১৯৯৫-এ পেলেন নাট্য অকাদেমি সম্মান। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে সম্মাননা জ্ঞাপন করেছিল।
বাংলামঞ্চের এই সুঅভিনেত্রীর প্রয়ান দিনে চ্যানেল হিন্দুস্তানের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লাইক শেয়ার ও মন্তব্য করুন
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন