কমলেন্দু সরকার :
প্রাচীনকালে মধ্যদেশে (পুরনো কালে ভারতে হিমালয় ও বিন্ধ্যপর্বত-এর মাঝে কোনও জায়গা) থাকতেন গৌতম নামে এক গরিব ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হলেও বেদ পড়া ছিল না তাঁর। অশিক্ষিতই ছিলেন। অভাবের তাড়নায় তিনি বেরিয়ে পড়লেন অর্থোপার্জনের আশায়। উপস্থিত হলেন এক গ্রামে। বেশ সমৃদ্ধশালী গ্রাম। এখানে ডাকাতদের বাস। এই গ্রামে এক ডাকাত ছিল তার প্রচুর টাকাকড়ি। সে ডাকাত হলেও অনেক দানধ্যান করত। ব্রাহ্মণ খবর পেয়ে গেলেন সেই ডাকাতের কাছে। তাকে বললেন, আমাকে একবছরের মতো খাবারদাবার আর থাকার জায়গা দাও। সবকিছুইই দিল সেই ডাকাত। গৌতম রয়ে গেলেন সেই গ্রামে। ডাকাতদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের মতোই হিংস্র আর নির্দয় হয়ে উঠলেন ব্রাহ্মণ। বিয়ে করলেন এক শূদ্রাণীকে।
অনেকদিন কেটে যেতে গৌতমের এক পরিচিত এলেন ওই গ্রামে। তিনিও ব্রাহ্মণ। গৌতম তখন গিয়েছিলেন শিকারে। শিকার ফেরত গৌতমকে দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। গৌতম তাঁর কাছে সব দোষ স্বীকার করলেন। বললেন, কালই আমরা এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। তবুও আগত ব্রাহ্মণ গৌতমের বাড়িতে অন্ন এবং জল গ্রহণ করলেন না।
ভোর হতেই তিনি চলে গেলেন। গৌতমও গ্রাম ছাড়লেন। তিনি যেতে যেতে দেখলেন একটা চমৎকার বাগান। ফুলে ফুলে ভরা। ঠান্ডা হাওয়ায় শুয়ে পড়লেন সেখানে। সূর্য ক্রমশ ঢ্লে পড়ছে পশ্চিমে। এমন সময় গৌতম দেখলেন একটা বক উড়ে আসছে আকাশপথে। তিনি ভাবলেন, এটাকে মেরে আজ রাতে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বক ব্রাহ্মণ বলল, আজ রাতে এখানেই থেকে যান। খাবারের ব্যবস্থাও করল। বক নদী থেকে মাছ ধরে আনল। রান্নার জন্য আগুনের ব্যবস্থাও করে দিল।
বক ব্রাহ্মণকে বলল, আমার নাম রাজধর্ম। আমার পিতা কশ্যপ। মাতা দাক্ষায়ণী সুরভি।
ব্রাহ্মণকে পত্র-পুষ্পের বিছানাও করে দিল বক। গৌতম তাঁর নিজের পরিচয় দিলেন। নিজের সম্পর্কে আর কছু ভাঙলেন না। বক এখানে আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমি খুব গরিব। অর্থের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। বকরূপী রাজধর্ম বলল, আপনি এখন বিশ্রাম করুন। আপনি যাতে ধনবান হতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দেব।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে ব্রাহ্মণ উঠলে বক তাঁকে বলল, এই পথ ধরে যাবেন। ঠিক তিন যোজন (প্রায় ২৫ মাইল) পেরোলেই পাবেন মেরুব্রজ নগর। সেখানেই থাকেন আমার পরমবন্ধু বিরূপাক্ষ। ও রাক্ষসরাজ। ওকে আমার নাম করে বলবেন। ও আপনাকে প্রচুর ধনরত্ন দেবে।
যেতে যেতে একসময় পৌঁছে গেলেন ব্রাহ্মণ মেরুব্রজে। রাজধর্ম পাঠিয়েছে শুনে ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন বিরূপাক্ষ। ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলে খুব-একটা প্রসন্ন হলেন না তিনি। রাক্ষসরাজ বুঝলেন সুবিধের লোক নয় ব্রাহ্মণ। রাজধর্ম যখন পাঠিয়েছেন তখন ব্রাহ্মণকে যথাযোগ্য সম্মান দেখালেন। বললেন, মাঘী পূর্ণিমার দিন ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াই আর কার্তিক পূর্ণিমায় ধনরত্ন দান করি। অন্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আপনাকেও ওইদিন দেব।
সেই দিন আগত হলে ব্রাহ্মণ সব বেঁধেছেদে রওনা সেই বাগানে। যেখানে বক অর্থাৎ থাকে। গৌতমকে খুশি হল বক। ব্রাহ্মণের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করল। গৌতম শুয়ে পড়লে বকও ঘুমিয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণ শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, আমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে। বককে মেরে তার মাংস খাওয়া যাবে। তাহলে খাবার ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। আর ভাবতে হবে না। ভাবা মতোই ঘুমন্ত বককে মেরে মাংসটা আগুনে ঝলসে নিয়ে বেঁধে নিল। বকের উপকারের ধার ধারলেন না ব্রাহ্মণ। এতটাই অকৃতজ্ঞ, নিচ!
ওদিকে রাজধর্মের অনুপস্থিতিতে অধীর হয়ে উঠলেন রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ। তিনি পুত্রকে পাঠালেন রাজধর্মের খোঁজ নিতে। তিনি বললেন, আমার মনে হচ্ছে ওই ব্রাহ্মণই রাজধর্মকে মেরেছে। ব্রাহ্মণকে দেখলেই বেঁধে নিয়ে আসবে।
বিরূপাক্ষপুত্র রাজধর্মের বাগানে এসে দেখে বাবার কথাই ঠিক। বকের পালক আর হাড় ডাঁই করে রাখা। আবার খোঁজা শুরু হল ব্রাহ্মণের। ধরা পড়ল গৌতম। বিরূপাক্ষ দেখলেন ব্রাহ্মণের কাছে তখনও রয়েছে রাজধর্মের অর্থাৎ বকের মাংস। তখনই নির্দেশ দিলেন এই ব্রাহ্মণকে হত্যা করে এর মাংস খেয়ে নিতে। কেউ রাজি হল না অকৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণের মাংস খেতে।
অন্যদিকে বিরূপাক্ষ বন্ধু রাজধর্মের শেষকৃত্যের জন্য দাহ করার ব্যবস্থা করতে বললেন। চিতা তৈরি করে তার ওপর রাজধর্মের কাটা ঝলসানো শরীর রাখা হল। রাজধর্মের মাতা দাক্ষায়ণী ওপর থেকে অমৃত দিলেন। রাজধর্ম আবার জীবন ফিরে পেল। রাজধর্ম শুনল সব কথা। ব্রাহ্মণ গৌতমকে ক্ষমা করলেন এবং করতেও বললেন বিরূপাক্ষকে।
প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে ব্রাহ্মণকে বিদায় দেওয়া হল। ধর্মপ্রাণ মহৎ মানুষেরা এভাবেই ক্ষমা করতে পারেন অপরাধীদের। ক্ষমা হল মহৎ মানুষের ধর্ম।
ব্রাহ্মণের মানসিক কোনও পরিবর্তন হল না। অর্থ নিয়ে ফিরলেন সেই ডাকাতদের গ্রামে। এখানে এসে শূদ্রাণীর সঙ্গে আবার থাকতে শুরু করলেন। ওঁদের সন্তানেরাও খারাপ হল। অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল ব্রাহ্মণকে।
দেখা গেল অসৎ সঙ্গে সর্বনাশই হয়।
(ঋণ স্বীকার: মহাভারতের গল্প, স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ)