সুমন ভট্টাচার্য
বাংলার রাজনীতির সিংহম ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়| ডাকাবুকো, কার্যকারিতায় অনবদ্য এবং সবসময় শিরোনামে| বিতর্ক পিছু ছাড়বে না, কিন্তু তিনি ক্রিজে থাকলে রান আসবেই| এবং মাঝেমধ্যেই সেটা সপাটে ওভারবাউন্ডারি হাঁকিয়ে|
তা না হলে কেউ মেয়র হিসেবে কর আদায়ের জন্য প্যান্টালুন্স এর বিপণির সামনে পুরসভার জঞ্জালের ভ্যাট দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন? গত ৫০ বছরে কলকাতার সফলতম মেয়র হিসেবে শহরবাসী হিসেবে যাঁকে মনে রেখেছে, সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় পেরেছিলেন| কর আদায় থেকে পরিষেবা, কলকাতার নাগরিক জীবনে সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়| এবং বৈশাখের সুবাতাস বইবে কি না, সেই তোয়াক্কা না করেই|
আবার বিরোধী নেতা হিসেবে চলচ্চিত্রোৎসবে ঢুকে যে শাসকের প্রতিবাদ করা যায়, সেটাও সুব্রত মুখোপাধ্যায় করে দেখিয়ে দিয়েছেন সেই কবে|
বিরোধী নেতা হিসেবে ক্ষুরধার,আবার প্রশাসক হিসেবেও দুর্দান্ত…এর পাশাপাশি অসামান্য রসবোধ, এমন লোককে সিংহম ছাড়া কি বলব? এবং সবসময় স্ট্রেট ড্রাইভে ৬ মারতে চাওয়ার ইচ্ছে, সুব্রত মুখোপাধ্যায় রাজনীতির ময়দানে মানেই হেডলাইন|
স্ট্রেটড্রাইভে কি ভাবে ৬ মারতেন? একটা ব্যক্তিগত গল্প শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না| এটা গত শতকের ৬ এর দশকের গল্প| প্রিয় সুব্রত, মানে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি আর সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ছাত্র যুবরা বামপন্থীদের প্রতিরোধ করছেন| আমার বাবা, মিহির ভট্টাচার্য্য উত্তর কলকাতার যুব কংগ্রেস সভাপতি| উত্তর এবং মধ্য কলকাতায় সেইসময় কংগ্রেস জমি ফিরে পাওয়ার মরিয়া লড়াইতে| সেই লড়াইতে যুব কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা নারায়ণ কর বেলেঘাটায় নিহত হন| আমার বাবা যেহেতু প্রিয় সুব্রত র গোষ্ঠী করতেন, সেহেতু উত্তর কলকাতার আরেক দাপুটে নেতা,প্রফুল্লকান্তি ঘোষ ওরফে শতদা তাঁকে সরিয়ে নিজের লোককে সভাপতি পদে বসাতে চাইছিলেন| আর প্রিয় কাকুও সেটা করতে চান না|
অগত্যা শত ঘোষ তাঁদের বাগবাজারে বাড়িতে প্রিয় সুব্রত কে খেতে আমন্ত্রণ জানালেন| এলাহি আয়োজন,অনেক রকম মাছ, মাংস ইত্যাদি| বাবাও রয়েছেন, সেই সময় হার্ডিঞ্জ হোস্টেল বাবাদের সহযোদ্ধা আরেক যুব কংগ্রেসি সুরিন্দর সিংহ আলুওয়ালিও আমন্ত্রিত| অনেক খাওয়া দাওয়ার পর হাত ধুতে ধুতে সুব্রত কাকু শত ঘোষকে বললেন, দারুণ খাওয়ালেন| কিন্তু এই যে হাত ধুয়ে ফেললাম, মিহির কে সভাপতি পদ থেকে সরানোর বিষয়টাও ভুলে গেলাম| আপনার শত অনুরোধেও আমি প্রিয়দাকে আপনার হাতে উত্তর কলকাতা তুলে দিতে দেব না|
গত শতকের রক্তঝরা রাজনীতির এই গল্পটা আমি এতবার এতরকমভাবে শুনেছি! প্রিয়কাকু হাসতে হাসতে বলতেন, চিংড়ি থেকে চিতল সব খেয়ে সুব্রত শতদার মুখের উপর বলে দিল! পরবর্তীকালে বিজেপি তে চলে যাওয়া সুরিন্দর সিংহ আলুওয়ালিয়া বিশাল পাগড়ি নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, শত ঘোষ পুরো তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন|
আর সুব্রত কাকু, মানে সুব্রত মুখোপাধ্যায়? নির্বিকার চিত্তে বলতেন, সোজা কথা মুখের উপর বলে দেওয়াই ভাল| আমি অত প্রিয় দার মতো ঘুরিয়ে ব্যাট করতে পারব না|
এই যে স্ট্রেইট ব্যাটে বাউন্ডারি হাঁকানোর অসাধারণ ক্ষমতা, এই জন্যই সুব্রত মুখোপাধ্যায় বাংলার রাজনীতির এত অসাধারণ চরিত্র ছিলেন| বাংলার রাজনীতির সিংহম|