দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় :
তৃণমূল ভবনে ঢুকে ডান দিকে গেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির মুখে দেওয়ালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছবি থাকত এক সময়। ২০১৪ সালের কোনও এক সময়ের পর আমি আর সে ছবি দেখিনি। শুনেছিলাম অন্য কোথাও আছে। এখনও সেটি অন্য কোথাও আছে নাকি আবার সেই পুরনো দেওয়ালে ফিরে এসেছে জানি না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বভাব প্রতিবাদী। গঙ্গা পেরিয়ে ট্যাক্সি যেই দক্ষিণেশ্বর ব্রিজ ছেড়ে বালি অঞ্চলে প্রবেশ করল, কবি বললেন, ‘গঙ্গার এপারের (পশ্চিম) লোকেদের একটা প্রতিবাদ করা উচিত।’ জিজ্ঞাসু চোখেরা প্রশ্ন করল কেন? কবি বললেন, ‘এদিকে তো কিছু নেই। একটা ভাল সিনেমা হল পর্যন্ত নেই।’ সেই যে বছর কবি জ্ঞানপীঠ পেলেন, এসব কথা সেই বছরের।
তাঁর এই প্রতিবাদ মনস্কতা তিনি এক সময় দেখতে পেয়েছিলেন একটি মেয়ের মধ্যে। যে মেয়েটি রাজনীতি করে। রাজনীতি বলে রাজনীতি! কংগ্রেস। যে দলটির বিরুদ্ধে সারা জীবন লিখে গিয়েছেন কবি। ‘জোড়া বলদে দেয়ালে লটকে ঠোঁট চেটে বলে ভোট দে’ কিংবা ‘সাবাধান বাঁয়ে যাস কে, ভাল চাস যদি ভোট দে ভুঁড়ি দাসদের বাস্কে।’ কী সব কবিতা! কী সব কবিতার লাইন! এই মানুষটিই কংগ্রেস করা মেয়েটির মধ্যে দেখতে পেলেন সম্ভাবনা। সেই সময়ের এক তরুন কবিকে বললেন, ‘দেখো, মেয়েটির হবে।’ ততদিনে তিনি কম্যুনিস্ট কবি থেকে একদা কম্যুনিস্ট হয়ে গিয়েছেন! সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলতেন, লিখেও গিয়েছেন, যাঁরা সমাজ বদলাতে চায়, মানুষ বদলালে তাঁরা এত গেল গেল রব তোলে কেন!
এই সময়ের একজন পরিচিত লেখক, যিনি বড় পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লেখেন, একটি ছোট পত্রিকাও প্রকাশ করেন। তিনি সুস্নাত চৌধুরী। যাঁর পত্রিকার নাম ‘বোধশব্দ’। ‘বোধশব্দ’ পত্রিকা তখন শব্দহীন ছিল। নাম ছিল ‘বোধ’। সেই পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন,” রাজ্যে ভূমি সংস্কার বলে কিছু হয় নি। যে জমি কৃষকদের দেওয়া হয়েছে তা এতদূরে দেওয়া হয়েছে যে কৃষকেরা সেই জমি রক্ষা করতে পারেন না। তাছাড়া এত কম জমি দেওয়া হয়েছে যে পরিবার বেড়ে যাওয়ার ফলে সে জমি তাদের কোনও কাজে লাগে না।” কবি বলেন কী! বামফ্রন্ট সরকারের গর্বের ভূমি সংস্কার! বললেই হল কিছু হয় নি! পত্রিকাটি হাতে নিয়ে এবং তাতে কি লেখা আছে শুনে স্বগোতোক্তির মত একজন বললেন, “কেউ যদি এসব বলে! কী করব! তাহলে জমিগুলো কোথায় গেল!” যিনি বললেন তিনি পত্রিকাটি ছুঁড়ে ফেলেও দিলেন। সেটা মোবাইলের যুগ ছিল না। তাঁর বক্তব্যের এ হেন প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়ে ওঠে নি কবিকে। বলা হয়নি আপনার সাক্ষাৎকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন জ্যোতিবাবু। আজ দু’জনেই অতীত। প্রতিবাদী কবি আর জননেতার এই বিতর্কটি দানা বাঁধার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে চিরকালের মত!
সেই সময় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন এমন সব কবিতা যা তৎকালীন সরকার বা শাসকদলের জন্যে মোটেই সুখকর নয়।
‘সাহেব
কবে গায়েব,
জমিদারিও মরে ভুত।
এখন যারা পড়ায় শোলোক
তারা নিয্যস পার্টির লোক।
গাঁয়ের প্রধান, বড় দারোগা
সবাই দোহার, ছুঁলে একবার আঠারো ঘা।’
অনেকদিন হয়ে গেল কবি নেই। আজীবন পদাতিক কবি। কবিতা না এলে হাঁটতে বেরোতেন। হেঁটে হেঁটে এসেওছে অনেক কবিতা। এসেছে, ‘পাগল বাবরালির চোখের মত আকাশ…’
কবি নেই, অনেকদিন হয়ে গেল। ভাড়া বাড়ির সামনের ঘরটার লাল মেঝেতে ফর্সা পা দুটো ডুবিয়ে শরতের মেঘের মত এক মাথা চুল নিয়ে কবি আর বসে থাকেন না। লেখালেখি করা কোনও ছেলেকে খসখস করে চাকরির সুপারিশ করা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেন না নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে! মহারাষ্ট্রে কবিতা পড়তে গিয়ে মিলিটারি রামে গলা ভিজিয়ে অতি সহজে বলতে পারেন, ‘গীতার সঙ্গে ওর আগের স্বামীর ঠিক জমল না জানো! তাই ও আমার কাছে চলে এল।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘সুভাষদার মত সহজ করে লিখতে পারলাম কই! সহজ মানুষ না হলে বোধহয় অত সহজ করে লেখা যায় না।’
কবি আর নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতি বছর গানে কবিতায় কবিকে স্মরণ করতেন কবির বাড়ির সামনে। ফুটপাথে পাঁজর ফাটানো সেই গাছের তলায়। সব ব্যবস্থা করতেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এখন আর মুখ্যমন্ত্রীর সময় হয় না সম্ভবত। তবে কয়েক বছর আগেও তিনি এমন একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি সুভাষদাকে মিস করি।’ সব মানুষেরই বোধহয় একজন বৌদ্ধিক অভিভাবক লাগে। চেতনার জগতের অভিভাবক। অধুনা কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর বেষ্টিত মুখ্যমন্ত্রীরও লাগে! তাই তিনি ‘সুভাষদাকে মিস’ করেন। অন্তত কয়েক বছর আগেও করতেন।
এই বছর কবি ৯৯ পার করলেন। শতবর্ষের দোরগোড়ায়। মুখ্যমন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দিয়েছেন। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সকালে কবির বাড়ি গিয়েছেন। ছবিতে মালা দিয়েছেন। কবিতা পড়েছেন। নবান্নে অমিত মিত্র মাল্যদান করেছেন কবিকে।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন কৃষ্ণনগর গিয়েছেন। কৃষ্ণনগর কবির জন্মস্থান। সেখানে কোথাও মমতা কী কবির কথা উল্লেখ করেছেন! জানা যায় নি।
আরও পড়ুন
https://channelhindustan.com/2018/02/subhas-mukhopadhyay-copy/
আরও পড়ুন
https://channelhindustan.com/2018/02/subhas-mukhopadhyay/
বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিয়ো পেতে চ্যানেল হিন্দুস্তানের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
https://www.youtube.com/channelhindustan
https://www.facebook.com/channelhindustan
Channel Hindustan Channel Hindustan is Bengal’s popular online news portal which offers the latest news