সঞ্জয় সিংহ :
‘দখল কায়েম’এবং ‘দখল হারানো’র রাজনীতিতেই এখন পাহাড় জ্বলছে।
রাজ্যে ক্ষমতার ‘পরিবর্তনে’র পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনঘন দার্জিলিঙে যাতায়াত করছেন। কোনও কোনও অনুষ্ঠানে বিজেপি-র জোট সঙ্গী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুঙ্গকেও, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হাসাহাসি করতে দেখা যাচ্ছে। এমনই এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘পাহাড়ের মা’ বলে অভিহিত করেছিলেন আবেগ আপ্লুত বিমল গুরুঙ্গ। আর সেইসময়ই পাহাড়ে শাসনে অতীতে বাম সরকারের ‘ব্যর্থতা’র কথা তুলে ধরে তাঁর আমলে ‘পাহাড় হাসছে’ বলে দাবি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা-রাজত্বের ৬ বছরের মাথায় সেই পাহাড়েই আজ আগুন জ্বলেছে। ‘মা-ছেলের’ ঝগড়া কেন বাধল? আগুনই বা জ্বলল কেন?
মমতা-রাজত্বে পাহাড় সত্যি হাসতে শুরু করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত পাহাড়ের আদি অধিবাসী লেপচাদের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী আলাদা বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন। শুধু লেপচাই নয়, পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ১৫ টি বোর্ড গঠন করেছে। পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাহাড়ের মানুষের ভিড়ে অবলীলায় মিশেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বামশাসনে এমন দৃশ্য পাহাড়বাসী থেকে রাজ্যবাসীর কাছে ‘অভাবনীয়’ ছিল। পাহাড়ের উন্নয়নে প্রশাসনিক নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি সেখানে শাসক দলের শাখা-প্রশাখা বিস্তারে তৃণমূলের তরুণ ‘তুর্কি’ অরূপ বিশ্বাস, ‘যিনি এখন পাহাড়ে অরূপ দাজু নামেই পরিচিত’ সক্রিয় হয়েছেন। তার ফল স্বরূপ, খোদ বিমল গুরুঙ্গের বোন যেমন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তেমনই সদ্য সমাপ্ত পুরভোটে মিরিক দখল করেছে শাসক দল। এমনকী, দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিংপঙে পুরসভাতেও খাতা খুলছে তৃণমূল।
তার ওপর জিটিএ সহপুরসভাগুলির অডিটও করেছে রাজ্য সরকার। এইসব মিলিয়েই প্রমাদ গুনেছেন বিমিল গুরুঙ্গরা। কারণ, তাঁদের আশঙ্কা হয়েছে। এতদিন ধরে পাহাড়ের তাঁরা যে মৌরসীপাট্টা গড়েছেন, এবার তাতে ভাঙন ধরছে। সবচেয়ে বড় কথা ১৯৮৬ সাল থেকে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে জি এন এল এফের আন্দোলনের ফলে পাহাড়ে কংগ্রেস, সিপিএমের অস্তিত্ব ক্রমশ বির্পযস্ত হতে শুরু করেছিল। বিমল গুরুঙ্গ, রোশান গিরিদের ‘গজমুমু’ পাহাড়ের দখল নেওয়ার পর সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। ঘিসিংয়ের আমলে যা চলছিল তা-ই কায়েম ছিল গুরুঙ্গদের রাজত্বেও। এবার পাহাড়ের বাইরের দল হয়ে তৃণমূল সেখানে ভাগ বসানোয় রোশন গিরি, গুরুঙ্গরা ‘অশনি সংকেত’ দেখেছেন। অন্যদিকে, মালদহ, মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু করে সারা রাজ্যে ‘কংগ্রেস-সিপিএমকে সাইনবোর্ড’ করার রাজনীতি পাহাড়েও বলবৎ করচে চাইছি তৃণমূল। কিন্তু পাহাড় আর সমতলে ভাষা, রাজনীতি এবং সামাজিক দিক থেকে অনেকটাই ফারাক রয়েছে তা হয়ত শাসকদলের নেতাদের অনেকেই টের পাননি।
লেপচা সহ পাহাড়ের জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নে রাজ্য সরকার বিভিন্ন বোর্ড গঠন থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার বার পাহাড় যাওয়ায়, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই খুশি হয়েছেন। কারণ, ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট রাজত্বে জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কতবার পাহাড়ে গিয়েছেন তা হাতে গুণে বলা যায়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড় সফর নিয়ে প্রথম দিকে গুরুঙ্গরা তেমন চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু পুরভোটের সময় থেকেই তাঁদের ক্ষমতা বা রাজনীতি জমি হারানোর আশঙ্কা হয়। তাঁরা ক্ষমতা বা রাজনীতির জমি হারানোর আশঙ্কা হয়। তাঁরা পরিকল্পনা করছিলেন কী ভাবে ‘হারানো জমি’ পুনরুদ্ধার করা যায়! এইসময়েই তাঁদের হাতে দু’টি মোক্ষম ‘হাতিয়ার’ তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সঙ্গী রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন।
রাজনৈতিক বা ক্ষমতার জমি ফিরে পেতে জি টি এ নির্বাচনের আগে পৃথক গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবি তুলে আবার আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা গুরুঙ্গ, রোশন গিরিরা আগেই করেছিলেন। তাতে বিজেপি নেতাদের একাংশের মদতও ছিল। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করা হবে বলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা গুরুঙ্গদের হাতে ‘অস্ত্র’ তুলে দিল। বেগতিক পরিস্থিতি বুঝে মুখ্যমন্ত্রী অবস্থান বদল করলেন ঠিকই। কিন্তু বাংলা ভাষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা পাহাড়ে নানা প্রশ্ন তুলে দিল। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন দার্জিলিং কি বাংলার বাইরে? কেন সেখানে বাংলা ঐচ্ছিক হবে? কেন চতুর্থভাষা হবে না।
ভাষা নিয়ে গোলমাল পরিস্থিতি মুখ্যমন্ত্রী সামাল দিলেও, সিপিএমের সঙ্গ ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া, অধুনা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের মন্তব্য, পাহাড়ে বারুদে অগ্নিসংযোগ করেছে। পাহাড়ে প্রকাশ্যে এক দলীয় সভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, মোর্চার ৩২ নেতাকে ট্রাঙ্ক বন্দি করে দার্জিলিঙের বাইরে চালান করা হবে। মোর্চা এবং তৃণমূল অন্দরের খবর, এই মন্তব্যই যত নষ্টের মূলে মোর্চা নেতারা এই মন্তব্য শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারকে বোঝাতে হবে-পাহাড়ে মোর্চার পায়ের তলায় মাটি এখনও সরে যায়নি। মোর্চার নেতা-কর্মীরা যে পাহাড়ে রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠক থাকাকালীনই তাঁদের ‘শক্তি প্রদর্শন’ করবেন এটা পুলিশ-গোয়েন্দারাও টের পায়নি। এটা অবশ্য রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা।
সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, পাহাড়ে খুব সতর্কভাবে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। সোজা কথায় যাকে বলে, ‘হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার।’ আশোকবাবু কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ খুব সংবেদনশীল। এমনকী তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘পাহাড়ে যা পরিস্থিতি সেখানে আলটপকা কোনও মন্তব্য বাঞ্ছনীয় নয়।” বস্তুত, পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ে সমতলের যে পথে তাঁরা হাঁটছেন, সেই রাস্তায় হাঁটলে হীতে যে বিপরীত হবে তা বুঝতে পারেননি তৃণমূল নেতাদের অনভিজ্ঞ অংশ।
অবশ্য সরকারের সঙ্গে লড়াই করার শাক্তি গুরুঙ্গদের কতটা আছে তা প্রশ্নের বিষয়। রাজ্যের মন্ত্রীদের অনেকেই মনে করেন, পুলিশ প্রশাসন অচিরেই ‘গজমুমু’র অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা ভেঙে দেবে। আইনের শাসন পাহাড়ে আছে থাকবে। গুরুঙ্গরা যে ‘অশান্তির রাজনীতি’ করছে তা অনেক রাজনীতিবিদের অভিমত। এমনকী এটা ‘হটকারী’ কাজ বলেই অনেকের ধারনা। কিন্তু যে দার্জিলিঙের অর্থনীতি পর্যটনের ভাষার অনেকটাই নির্ভরশীল, তা কিন্তু সাম্প্রতিক গোলমালে ধাক্কা খেতে বাধ্য। তার ওপর রাজ্যে এখন তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি-ও গোপনে গুরুঙ্গদের সঙ্গে শলা-পরামর্শে তলে তলে তাল ঠুকেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দার্জিলিংকে আবার চেনা ছন্দে ফিরিয়ে আনেন, এখন সেটাই দেখার।
Check Also
আদবানি-সখ্যে সংকোচহীন ছিলেন বুদ্ধ
জয়ন্ত ঘোষাল : লালকৃষ্ণ আদবানির বাড়িতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মধ্যাহ্ন ভোজে আসবেন। বাঙালি অতিথির আপ্যায়নে আদবানি-জায়া …
নির্মলার কোনও অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা নেই
সুমন ভট্টাচার্য এবারের বাজেটটা না গরিবের না মধ্যবিত্তের না ব্যবসায়ীদের কাউকে খুশি করতে পারলো। দেখে …
শুধুমাত্র শুদ্ধিকরন আর বাংলাদেশ নয়, মমতার যে কথায় কান দিল না মেইনস্ট্রিম মিডিয়া
“ভর্সা যেন না পায় কোনও দাঙ্গামুখো হতচ্ছাড়া, সবাই মিলে বেঁচে থাকার ভর্সা তাদের করুক তাড়া’ …