Breaking News
Home / TRENDING / নজরুল ও আর এস এস

নজরুল ও আর এস এস

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

 :

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ সম্পর্কে একটি ভুল এবং বিকৃত ধারণা প্রচারিত আছে সেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে। মূলত, এই ধারণাটি রটেছে কংগ্রেসি এবং বামপন্থীদের সৌজন্যে। এই ভুল এবং বিকৃত ধারণাটি কি? ধারণাটি এই যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ মুসলমান-বিরোধী। মজার কথা হল — যাঁরা আর এস এস সম্পর্কে এমন একটি ধারণা রটিয়েছেন তাঁরা কেউই কিন্তু হলফ করে কখনও বলতে পারবেন না — আর এস এস কোথাও মুসলমানমুক্ত ভারত গড়ার কথা বলেছে বা বলে। নিঃসন্দেহে আর এস এস হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এক্ষেত্রে আর এস এসের কোনও লুকোছাপাও নেই। কিন্তু আর এস এস তার সাংগঠনিক লক্ষ্যে পরিষ্কার একথাও বলেছে যে, ভারতে বসবাসকারী মুসলমান মাত্রেই খারাপ — এমনটা তারা কখনও মনে করে না। বরং, আর এস এস এটাই বলে, ভারতে বসাসকারী মুসলমানদেরও ভারতর্ষের প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে, ভারতপ্রেম থাকতে হবে — এটাই কাম্য। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এ-ও মনে করে, এই ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকই সংস্কৃতিগতভাবে হিন্দু — ধর্মাচারণে তিনি যা-ই হোন না কেন। ঠিক এমনটিই মনে করতেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কংগ্রেসি মন্ত্রী এম সি চাগলা। চাগলা বলেছিলেন — ধর্মাচারণে আমি মুসলমান হলেও, সংস্কৃতিগতভাবে আমি হিন্দু। আর এস এসের এই ধারণার ভুল ব্যাখ্যার কারণেই আজ আর এস এস যখন নজরুল জন্মদিবস উদযাপনের কথা বলে তখন কেউ কেউ বলতে শুরু করেন নজরুল জন্মদিবস উদযাপনের মাধ্যমে আসলে আর এস এস দল ভারী করতে চাইছে। এই ‘দল ভারী’ কথার ভিতর দিয়ে এরা কি বোঝাতে চাইছেন তারাই জানেন।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ যেমন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, তেমনই মুসলিম সংগঠন, খ্রিস্টান সংগঠন, বৌদ্ধ সংগঠনও এদেশে আছে। আর এস এস যেমন হিন্দুদের সংগঠিত করার কথা বলে, তেমনই ওইসব সংগঠনগুলি স্ব স্ব ধর্মের মানুষদের সংগঠিত করার কথা বলে। সমস্যা হল — স্বাধীনতার পর থেকে এইসব সংগঠনের বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথাবার্তা বলেননি। মনে হয়, হিন্দুদের সংগঠিত হতে বলার কথাতেই আপত্তি। এই যে হিন্দু বিরোধী মানসিকতা এরও একটি ইতিহাস আছে এদেশে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মেকলে চেয়েছিলেন এমন একটি ভারতীয় সমাজের জন্ম দিতে যে-সমাজ ভারতের চিরন্তন দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্মন্ধে অশ্রদ্ধাবান হবে। মেকলে বুঝেছিলেন ভারতের মেরুদণ্ডটি হল তাঁর হিন্দু সংস্কৃতি। তাকে আঘাত করতে পারলেই ভারতীয়দের মানসিকভাবে দাস বানিয়ে রাখা যাবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত মুসলমান শাসকরাও বুঝেছিলেন হিন্দু ভাবনার ওপর আঘাত করলেই ভারতকে পদানত করা যাবে। যে-কারণে, মুসলমান শাসকরা হিন্দু দেবালয়গুলি চূর্ণ করা বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসক এবং মেকলে ছিলেন অনেক ধূর্ত। তাঁরা বুঝেছিলেন বৃহৎ ভারতীয় সমাজের ভিতর শিক্ষিত অংশকে ভারতের পরম্পরা সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীন করে তুলতে হবে। সফল হয়েছিল ব্রিটিশ শাসক। এদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন — ‘সংস্কৃতিগতভাবে আমি মুসলমান; আর দুর্ঘটনাবশত আমি হিন্দু’। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই নেহেরুপন্থী এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাই এদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মেধাচর্চার কেন্দ্রগুলিতে মৌরসিপাট্টা গেড়ে রয়েছে। এবং এরাই নিরন্তর আর এস এস সম্পর্কে মিথ্যাচার করে চলেছে।

এতখানি কথা এই কারণেই বললাম — কেননা কাজী নজরুল এবং আর এস এস সম্পর্কেও এঁদের মিথ্যাচারটি অব্যাহত। কাজী নজরুলের অসুস্থতা যখন প্রথম ধরা পড়ল — তখন এই রাজ্যে ফজলুল হক – শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রীসভা। জনসংঘের নেতা শ্যামাপ্রসাদ। হিন্দুত্ববাদী। আর এস এসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আর এস এস-ও বরাবর তার আদর্শের অনুসারী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জনসংঘই পরে ভারতীয় জনতা পার্টি। এ হেন শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু নজরুলের অসুস্থতার সংবাদ শুনে সর্বপ্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নজরুলের কমিউনিস্ট বন্ধুরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগে নজরুলের চিকিৎসার জন্য অর্থ সংঘের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ নিজেও অনেক অর্থ সাহায্য করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, পরবর্তী কালে অভিযোগ উঠেছিল যে নজরুলেরই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তি সেই অর্থ নয়ছয় করেছেন। আজকে যাঁরা বলছেন, নজরুল জয়ন্তী পালনের ভিতর আর এস এস দলভারী করছে, তাঁরা জানেন না আর এস এস বরাবরই নজরুলকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ পাশাপাশি আর এস এস নজরুলের বাংলাও বলে থাকে। আর এস এসের প্রকাশনায় ‘বাংলার মনীষীদের ভাবনায় হিন্দুত্ব’ শীর্ষক যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থখানি প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, বঙ্কিমচন্দ্রের সমমর্যাদাতেই নজরুলও রয়েছেন। কাজেই আজ যদি আর এস এস নজরুল জয়ন্তী পালন করার উদ্যোগ নেয় সেটা দলভারী করার জন্য নয়। আর এস এস তার আদর্শের অনুসারেই নজরুলকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছে এটা মনে রাখতে হবে। আর এটাও মনে রাখতে হবে নামের শেষে ঠাকুর বা কাজী থাকলেই কেউ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের ঠিকাদার হতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল কারওর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তিও নন। তাঁরা সমগ্র বাঙালির, সমগ্র ভারতীয়র। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর ভিতর যাঁরা ‘দলভারী’ করার রাজনীতি খোঁজেন আসলে তাঁরাই অন্য কারওর দলভারী করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

Spread the love

Check Also

রাহুলের পাইলট প্রোজেক্ট, মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসে আধিপত্য হারাতে পারেন অধীর

দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে রাহুল গান্ধির নতুন উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস রাজনীতিতে খর্ব হতে পারে অধীর …

আমি আসছি! নাম না করে শুভেন্দুকে শাসালেন আনিসুর

চ্যানেল হিন্দুস্থান, নিউজ ডেস্ক: নাম না করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারিকে শাসালেন আনিসুর রহমান। একদা …

আগামী সপ্তাহে শতাধিক ট্রেন বাতিল হাওড়া-বর্ধমান শাখায়

চ্যানেল হিন্দুস্থান, নিউজ ডেস্ক: উন্নত পরিষেবা পেতে চলেছে পূর্ব রেল হাওড়া-বর্ধমান কর্ড শাখায়, আর তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *