সুমন ভট্টাচার্য :
কথায় আছে যার শুরু ভাল, তার শেষও ভাল।
এই লকডাউনের পৃথিবীতে বৈশাখ বা নতুন বছর যে অন্যভাবে শুরু হতে যাচ্ছে, তা তো আমরা জানতামই। কিন্তু সেটা যে একেবারেই অন্যভাবে সেটা টের পেলাম যখন দেখলাম বাংলার এক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, যাঁর অক্টিভিস্ট কন্যা মাত্র দশ দিন আগে তাঁর মায়ের নির্দেশ মতো নরেন্দ্র মোদীর দাড়িতে আগুন ধরিযে দিতে চেয়েছিলেন, সেই তিনিও সঙ্কটকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কী কান্ড! এতো দেখি করোনা যুগে নব বাল্মীকি , মরা মরা বলতে রামের নাম জপা! মাফ করবেন, রামায়ণ যদি হিন্দুত্ববাদের উল্লেখ হয, তাহলে না হয় এটাকে রাগ থেকে অনুরাগই বললাম।
প্রগতিশীল সংবাদপত্রে নববর্ষের কলমে প্রগতিশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবী যখন নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেছেন, তখন জানতামই পয়লা বৈশাখের বক্তৃতায় আরেকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী বুঝিযে দেবেন কেন তিনি এইসব ক্রমশ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। লকডাউন যে বাড়ছে, সেটা তো তিনি আগেই রাজনীতিতে তাঁর ঘোর শত্রু বলে পরিচিত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিবাল আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাযকে দিয়ে বলিযে দিযেছিলেন। তাহলে মঙ্গলবার তিনি কি বলবেন?
নরেন্দ্র মোদী যা বললেন তার পরিষ্কার মানে করলে দাঁড়ায়, ভারত তার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে খড়ের গাদায সুঁচ খুঁজবে না। লকডাউনের প্রথম একুশ দিনে মোটামুটি ভাবে সরকার জানে, কোথায় কোথায় সুঁচ আছে। সেইসব হটস্পটগুলিকে এবার চিহ্ণিত করে একেবারে কড়়া নজরে রাখা হবে, যাতে সেখান থেকে অন্য কোথাও সংক্রমণ ছডিয়ে না পড়ে। সেখানে সম্ভাব্য রোগীদের খুঁজে বার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাঁদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের কোয়ারেনটিনে পাঠানো, এগুলোকেই জরুরি ভিত্তিতে করা হবে। এই হটস্পটের বাইরে যদি করোনাকে বেরোতে না দেওযা যায়, তাহলে যে মে মাসের শুরুতে করোনা প্রতিরোধে ভারত অনেকটা এগিয়ে থাকবে, সেটাও মোদী পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
আধুনিক পৃথিবীর রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীকে যে কেন মাস্টার কমিউনিকেটর বলা হয, সেটা এই করোনা সঙ্কটে তাঁর তৃতীয় বার জাতির উদ্দেশে ভাষণেও পরিষ্কার করে বুঝিযে দিযেছেন তিনি। এর আগে তিনি ১৩০ কোটি ভারতীয়কে দিয়ে জনতা কারফিউ পালন করিয়েছেন, চিকিৎসক এবং করোনার বিরুদ্ধে লডাইতে যাঁরা জরুরি পরিষেবা দিচ্ছেন, তাঁদের সম্মানে ঘন্টা বাজিযে সম্মানজ্ঞাপন করিয়েছেন, আবার অকাল দীপাবলীতে দেশকে একসূত্রে গেঁথেছেন। এবারও তিনি আগামী ৬ দিন, অর্থাৎ ২০ এপ্রিল পর্যন্ত চূড়ান্ত সতর্ক থাকার দাযিত্ব দেশবাসীকেই দিয়েছেন। একইসঙ্গে বলে দিয়েছেন, কোনও থানা, কোনও জেলা বা কোনও রাজ্য কিভাবে পারফর্ম করল, সেটা যাচাই করেই ঠিক হবে পরের ১৩ দিন, অর্থাৎ ২১ এপ্রিল থেকে সেই জেলা বা রাজ্য অতি আবশ্যকীয় কিছু কাজ চালু করার জন্য ছাড় পাবে কি না।
আমরা যে ইউরোপ বা আমেরিকার থেকে ভাল জায়গায় রয়েছি, সেটা যেমন মনে করিযে দিয়েছেন, তেমনই পরিষ্কার করে দিয়েছেন জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের এখন কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।
নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার বা কমিউনিকেশনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কঠিন কথা সহজ করে বলা। টিপিকাল বামপন্থী ন্যারেটিভের মতো তাঁর কোনও চিৎকৃত সর্বহারার মুক্তিতেই বিশ্বের মুক্তি টাইপের শ্লোগান নেই, কিন্তু তিনি সর্বক্ষণ মনে করিযে দিয়ে যাবেন আপনার পাশের প্রান্তিক মানুষটিকে দেখুন, তাঁকে সাহায্য করুন। বলবেন, আপনি যদি ব্যবসায়ী হন, কাউকে ছাঁটাই করবেন না, আপনার সহকর্মীদর সাহায্য করুন।
আসলে নরেন্দ্র মোদী জানেন বিন্দু দিয়েই সিন্ধু তৈরি হয়।