নিজস্ব প্রতিনিধি :
আগামিকাল জন্মাষ্টমী। এই দিনেই আবির্ভাব হয়েছিল লোকনাথ ব্রহ্মচারীর। সময়টা বাংলার ১১৩৮ সাল। বাবা রামনারায়ণ ঘোষাল। মা কমলা দেবী। রামনারায়ণের ইচ্ছা ছিল তাঁর যে-কোনও একটা পুত্রসন্তান সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করুক এবং ভগবানের নামকীর্তন করে বংশের পবিত্রতা রক্ষা করুক। লোকনাথের জন্ম হলে রামনারায়ণ তাঁকেই বেছে নিলেন সন্ন্যাসব্রতের জন্য।
লোকনাথের বয়স তখন ১১। উপনয়নের সময় উপস্থিত। রামনারায়ণের বাড়ির কাছেই থাকতেন সর্বশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি। লোকনাথের বাবার ইচ্ছাতেই উপনয়নপর্ব সমাপ্ত হতেই পুত্রকে সন্ন্যাসবব্রতের জন্য ভগবান গাঙ্গুলির হাতে তুলে দিলেন। লোকনাথ দণ্ডি বেশেই গুরু ভগবানের সঙ্গে বনবাসী হওয়ার উদ্দেশে রওনা দিলেন। সঙ্গী হলেন লোকনাথের বন্ধু বেণীমাধব।
লোকনাথ এবং বেণীমাধবকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী করার জন্য নক্তব্রত, একান্তরা, ত্রিরাত্র, পঞ্চাহ, নবরাত্র, দ্বাদশাহ, মাসাহ ইত্যাদি ব্রত পালন করিয়েছিলেন। লোকনাথের সন্ন্যাস গ্রহণের ১২ বছর অতিক্রান্ত। ভগবান গাঙ্গুলি বিভিন্ন তীর্থ ঘুরিয়ে লোকনাথকে আবার নিয়ে এলেন তাঁর গ্রামেই। এখানে মাস ছয়েক ছিলেন। এই গ্রামে এক ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে লোকনাথের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। ১২ বছর পর লোকনাথ এসে দেখেন সেই মেয়েটি বালবিধবা রূপে ব্রহ্মচর্য পালন করছে। ভগবান আবার লোকনাথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সেইসময় মেয়েটিও তাঁদের সঙ্গে বেরোতে চাইলে লোকনাথ তাঁকে সন্ন্যাসধর্মের কঠোরতা বোঝালেন। বেরিয়ে পড়লেন আবার গুরুর সঙ্গে। লোকনাথ আর বেণীমাধবকে নিয়ে তুষারাবৃত হিমালয়ে। পাহাড়ে তাঁরা কঠোর যোগসাধনায় মগ্ন থাকতেন। পরবর্তী কালে সিদ্ধিলাভও করলেন। এইসময় লোকনাথের বয়স ৯০ আর গুরু ভগবানের ১৫০। এরপর লোকনাথ আর বেণীমাধবকে নিয়ে এলেন কাশীধামে। এখানে সিদ্ধপুরুষ হিতলাল মিশ্রের হাতে দুই শিষ্যকে তুলে দিয়ে মণিকর্ণিকা ঘাট যোগাসনে বসে দেহত্যাগ করলেন ভগবান গাঙ্গুলি। কঠোর তপস্যার সময়ই লোকনাথ জাতিস্মরতা লাভ করেছিলেন।
কাশীধামে আসবার আগেই গুরুর সঙ্গে লোকনাথ কাবুলে গিয়ে তৎকালীন বিখ্যাত কবি মোল্লাসাদীর বাড়িতে কোরান শিক্ষা করেছিলেন।
গুরুর ভগবানের দেহত্যাগের পরই লোকনাথ হেঁটে হেঁটে মক্কায় যান। একবার নয়, তিনবার। সেখানে থাকার সময় মুসলমানেরা তাঁকে খুব ভক্তি করতেন। মুখ কাপড় বেঁধে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্য খাবার বানিয়ে দিতেন। লোকনাথ তা খুব আয়েশ করে খেতেনও। এরপর লোকনাথ আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত যান। তারপর আবার রওনা দিলেন হিমালয়ে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী সর্বত্রই গেছিলেন। সে আফগানিস্তান হোক বা তিব্বত।
এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকার বারদিতে। তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ফৌজদারি মামলার আসামি। তাঁকে অভয় দিয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, তুই যাওয়া মাত্রই খালাস হবি। তাই-ই হয়েছিল। বারদিতে শুরু হয়েছিল লোকনাথের অলৌকিক লীলা। লোকনাথের মহিমার কথা ছড়িয়ে পড়তে বেশি দেরি হল না। এখানে তিনি ছিলেন ২৬ বছর। বারদি তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বারদির গোঁসাই নামে। একবার বারদির আশ্রমে এক মহিলা একবাটি দুধ নিয়ে এলেন লোকনাথের খাওয়ার জন্য। লোকনাথের হাতে তা দিতেই তিনি “আয়, আয়” বলে ডাক ছাড়লেন। কিছুক্ষণ পর বিশাল এক কেউটে সাপ এলে তার ফণা ধরে দুধ খাওয়ালেন। তারপর সাপটিকে চলে যেতে বললে চলেও যায়। এরপর নিজে দুধটা খেলেন। আসলে তাঁর কৃপায় আশ্রমে কেউই অভুক্ত থাকত না।
লোকনাথ বারদিতে থাকাকালীন বহু মানুষের ভাল করেছেন। অনেককে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সারিয়ে তুলেছিলেন। আসলে লোকনাথ ব্রহ্মচারী কর্মযোগের চরম ফল লাভ করেছিলেন।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলতেন, ভক্ত আর ভগবান এক। ভগবানকে কারওর জানার শক্তি নেই। তিনি দয়া করে যাঁর কাছে প্রকট হন তিনিই বুঝতে পারেন। ভক্তরূপী ভগবানও তেমনই মানুষের কাছে ধরা না দিলে মানুষের সাধ্য নেই যে তাঁর মহিমার অন্ত পাবে। এখানেই স্পষ্ট যে লোকনাথের সঙ্গে ভগবানের কোনও পার্থক্য নেই। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রতি রোমকূপেই দেবতা।