সুমন ভট্টাচার্য :
বামপন্থী নেতারা বারবার বলছেন দেশ রসাতলে যাচ্ছে! কারণ, গান্ধী এবং নেহরুর আদর্শ থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি! খুব ভালো কথা। কিন্তু বামপন্থী নেতারা কবে থেকে এত গান্ধী-নেহেরুর ভক্ত হলেন? যদি আজ তাঁরা গান্ধী-নেহেরুর ভক্তই হন, তাহলে ৫০ বা ৬০ এর দশকে বামপন্থীদের যাবতীয় আন্দোলন কী ভুল ছিল! সেদিন যে আগুনখেকো বিপ্লবীরা গান্ধী এবং নেহরুকে তুলোধোনা করতেন, সেগুলো কী সব ভুল ছিল! বি টি রনদিভে থেকে বাসবপূন্নাইয়ারা ভুল পার্টি লাইন নিয়ে চলছিলেন? আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে গোপালন ভবনের এ নিয়ে কোনও উত্তর আছে? যাঁরা পার্লামেন্টকে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ বলেছিলেন, এবং ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন, তাঁরা কবে থেকে গান্ধী এবং নেহরুর এত গুণমুগ্ধ গুণগ্রাহী হয়ে গেলেন?
সত্যজিৎ রায়-এর ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এ তে রাজার যমজ ভাই-এর একটা সংলাপ ছিল, ‘রাজকন্যা কি কম পড়িতেছে?’ এখন বামপন্থীদেরও তেমনই জিজ্ঞাসা করতে হয়, ‘মার্কস-লেনিন কি কম পড়িতেছে?’ সেই জন্যই কী গান্ধী-নেহরুর দিকে হাত বাড়াতে হল! বামপন্থী দলের নেতারা যত বলছেন, তার চাইতেও বেশি করে বলছেন বামপন্থী তাত্ত্বিকরা। খবরের কাগজে লিখছেন, ফেসবুক ভরে যাচ্ছে বামপন্থী তাত্ত্বিকদের কান্নায়, ‘গান্ধী-নেহরুর ভাবাদর্শকে কেমনভাবে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিল মোদীর বিজেপি’, এই হা-হুতাশে। স্টালিনকে ছেড়ে, মাও-এর চেয়ারম্যানশিপকে অগ্রাহ্য করে লালপার্টির নেতারা যে এইভাবে গুজরাটের এক অর্ধনগ্ন ফকিরকে জাপটে ধরবেন, সেটা বোধহয় অতি বড় গান্ধীভক্তও ২৫ বছর আগে আন্দাজ করতে পারেননি। এমনকী যাঁরা অতিবাম, ৬০-৭০ দশকে ‘চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’ বলে ঘনঘন স্লোগান দিতেন, তাঁদের মুখেও আজকাল গান্ধী এবং নেহরুর জয়গান! এই অতিবামরা ষাট এবং সত্তরের দশকে কংগ্রেসকে গালি পাড়তেন, নেহরুকে ‘বুর্জোয়া’, গান্ধীকে উজবুক-এইসব আখ্যায় ভূষিত করতেন। ‘নকশালবাড়ির সংগ্রামের পথ’ পরিত্যাগ করে তাঁরা যখন দেশের বিভিন্ন শহরে থিতু হলেন, তখন কেউ অধ্যাপক, কেউ চলচ্চিত্র নির্মাতা বা কেউ এনজিও-এর কেষ্ট-বিষ্টু হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও তাঁদের মুখে চিন কিংবা রাশিয়ার ‘উন্নততর সমাজব্যাবস্থা’র গল্প শোনা যেত। গর্বাচভ ‘গ্লাসনস্ত’ আর ‘পেরেস্ত্রৈকা’র এমন ধাক্কা দিলেন, যে এই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বাকরহিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার এক বামপন্থী বান্ধবী, যার বাবা এদেশের প্রগতিশীল বাম আন্দোলনের ‘পুরোধা’ ছিলেন, তিনি একবার দূ:খ করে বলেছিলেন, ৮০র দশকে রাশিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পর তাঁদের গোটা পরিবার নাকি ‘সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার’-এ চলে গিয়েছিল! বাম এবং অতিবামেদের এই ‘সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার’-এরই পরিণতি আজকের নেহরু-গান্ধীকে জাপটে ধরা?
দিল্লিতে রাষ্টপতি প্রনব মুখোপাধ্যায়-এর দেওয়া ইফতার-এ মোদী মন্ত্রীসভার কোনও সদস্য বা বিজেপির কোনও নেতা উপস্থিত ছিলেন না। তাতে বিষম চটে গিয়ে সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই ধরনের ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। মানে? তাহলে কি ইফতার-এর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে এবার থেকে বামপন্থীরা নিজেদের রাজনীতির অঙ্গ হিসাবে মেনে নিল? এবার থেকে কি বামেদের কাছে ‘কমিউনিষ্ট ম্যনিফেস্টো’ বা ‘দাস ক্যপিটাল’-এর পাশাপাশি ‘কুরাণ’ বা ‘হাদিস’ও সমান গুরুত্ব পাবে? অসুবিধা নেই। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তো ‘গীতা’র ভক্ত ছিলেন। তাহলে অধুনা গান্ধীভক্ত বামপন্থীদের ইফতারের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে আর ছুঁতমার্গ থাকবে কেন? শুধু মনে পড়ছে, ২০১৬ এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে সনিয়া গান্ধীর দেওয়া ইফতারকে এড়িয়ে গেছিল সিপিএম, শুধু এই যুক্তি দিয়ে যে তারা কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না। সেদিন আসলে সনিয়া গান্ধীর পাশাপাশি বসে থাকা তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে এড়াতে বলা হয়েছিল সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমকে। এখন মোদীর ধাক্কায় কী সিপিএমকেও ইফতারের গুণগান করতে হচ্ছে!
গোটা দেশের বামপন্থীরা যখন গান্ধী এবং নেহরুর আদর্শকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর, তখন ফরওয়ার্ড ব্লকের দুই শীর্ষ নেতা চিন যাচ্ছেন। কেন? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে কীভাবে তীব্রতর করা যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করতে! এই ২০১৭ সালে যে বামপন্থী দল চিন যায় পুঁজিবাদ বিরোধী কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে, তাদের নামের সঙ্গে ‘ফরওয়ার্ড’ শব্দটি কিভাবে যুক্ত থাকতে পারে?
গ্রাফিক্স:মধুমন্তী
লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট করুন
ভিডিয়ো পেতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন