‘ঝড়ের ঠিকানা- পর্ব ১৩ ’
সঞ্জয় সিংহ :
(জনপ্রিয় এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক সঞ্জয় সিংহের স্মৃতিসরণিতে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) :
তাঁর অনেক রাজনৈতিক পদক্ষেপের কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্টরাও বুঝতে পারে না। ২০০১ সালে ভোটের প্রাক মুহূর্তে এনডিএ কেন ছাড়লেন এবং তারপর আবার কেন ঢুকলেন তাঁর সুস্পষ্ট ব্যাখা তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীরাই পাননি। মনে পড়ছে, ২০০২ সালে জানুয়ারিতে দীঘায় তৃণমূলের দু’দিনের রাজনৈতিক সম্মেলনের কথা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই সম্মেলন শেষে গোপনে বলেছিলেন, “এনডিএ ছাড়ার পর কেন আবার সেই জোটে আমরা ঢুকলাম, সম্মেলনে তা নিয়ে কোনও কথাই তো হল না!”
আসলে এটাই তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক কৌশল। ১৯৯৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে দলীয় প্রার্থী বাছাই নিয়ে কী কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা অনেকেই জানেন! সেবার সোমেন মিত্রের ঘনিষ্ঠ চার কংগসের প্রার্থী মনোনয়নের প্রতিবাদ জানিয়ে মমতাদি আলিপুরে গলায় কালো শাল জড়িয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কংগ্রেসের ওই চার প্রার্থী ছিলেন— সুলতান আহমেদ, শঙ্কর সিং, মৃণাল সিংহ রায় ওরফে আবু, এবং অধীর চৌধুরী। মমতাদির দাবি ছিল, ওঁরা অপরাধী বলে চিহ্নিত হয়েছে, ওঁদের প্রার্থী করা চলবে না। মজার ঘটনা হচ্ছে, ওই চারজনের মধ্যে সুলতান আহমেদ এখন তৃণমূলের সাংসদ এবং বিধায়ক শঙ্কর সিং কংগ্রেস ছেড়ে এখন তৃণমূলের নেতা। সদ্য সমাপ্ত নদীয়ার কুপার্স ক্যাম্পে পুরভোটে এই শঙ্কর সিং-এর হাতেই দলের হয়ে ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতাদি। শঙ্কর তাঁর মর্যাদাও রেখেছেন। সুলতান এবং শঙ্কর দু’জনেরই ওপর সাংগঠনিক কাজে আস্থা রাখেন তৃণমূল নেত্রী। অবশ্য অধীরকে এখনও তিনি কব্জা করতে পারেননি। কিন্তু একদিন যাঁদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, আজ তাঁদেরই কেন কাছে টেনে নিয়েছেন তার কোনও ব্যাখ্যা তৃণমূলনেত্রীর কাছ থেকে মেলেনি।
যেমন ব্যাখ্যা মেলেনি, ২০০৬ সালে মালদহ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে কেন তৃণমূলনেত্রী সমর্থন করেছিলেন। সে’বার মালদহে কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন প্রয়াত বরকত গনিখান চৌধুরীর ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী ওরফে ডালুবাবু। কেন মমতাদি তাঁকে সমর্থন জানালেন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক সেই সময় হয়েছিল। কারণ, তৃণমূল তখনও এনডিএতে রয়েছে এবং ঘটনার মাত্র কয়েকমাস আগেই বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পার্থী দিয়েছিল তৃণমূল। ডালুবাবু দাঁড়িয়েছিলেন কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রে। সেখানে মমতাদি তৃণমূলের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় ডালুবাবুকে প্রায় আড়াই হাজার ভোটে হারতে হয়েছিল। এমনকী সেবার সুজাপুরে ডালুবাবুর বোন রুবি নূর-এর বিরুদ্ধেও প্রার্থী দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তবে রুবি নূরকে হারানো যায়নি। মালদহ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ডালুবাবুকে সমর্থন করার বিষয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, “বরকতদার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করেছি।” তাহলে বিধানসভা ভোটে কেন সমর্থন করেননি? উওর মেলেনি।
এনডিএ-তে যোগ দেওয়া, ছাড়া এবং প্রত্যাবর্তন ও আবার ছেড়ে বেরিয়ে আসার নানা ব্যাখ্যা বিভিন্ন সময় তৃণমূলনেত্রী দিয়েছেন। এমনকী গুজরাত দাঙ্গার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সরানোর দাবিও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে জানিয়েছিলেন মমতাদি। কিন্তু সেইসময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে এনডিএর সঙ্গ ছাড়েননি। আবার রেল বিভাজন নিয়ে তিক্ততার পরেও দীর্ঘ কয়েকমাস দফতর বিহীন মন্ত্রী হয়েও এনডিএ-র সঙ্গে ছিলেন মমতাদি। সেইসময় তাঁর বক্তব্য ছিল, “অটলজি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ। ওঁকে শ্রদ্ধা করি। উনি আমাকে মন্ত্রীত্বে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলেই ছিলাম।”
সেই জোটে থাকার কি ফল হল? ২০০৪ সালের ভোটে এনডিএ বিপর্যস্ত হল। সংসদের ভিতরে-বাইরে মমতাদি একলা হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ‘একলা পথের পথিক’ আবার কী করে ঘুরে দাঁড়ালেন, সে কাহিনি পরের বার।